মৌ যখন শ্যামা by জাহীদ রেজা নূর

ধানমন্ডিতে মৌ-এর অফিসে এসেছি। কথা হবে নৃত্যশিল্পী মৌকে নিয়ে। এই পরিচয়েই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
ভাবনাটা এসেছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস নিয়ে কী করা যায়, সেটা থেকেই। আমাদের মনে হলো, এমন দিনেই রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্রগুলো নিয়ে কথা বলা যায়।


যিনি শ্যামা, চিত্রাঙ্গদাসহ রবীন্দ্রনাথের অনেক চরিত্র নিয়ে মঞ্চে এসেছেন, তাঁর সঙ্গেই আলাপটা জমবে ভালো। তাই দ্বিতীয় কোনো নাম ভাবতে হয়নি, সাদিয়া ইসলাম মৌকে নিয়েই আজ আমাদের আয়োজন।
মনে পড়ছে, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে শ্যামা নৃত্যনাট্যটি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেখানে মূল চরিত্রটি করেছিলেন মৌ। এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। এখনো নাচের সঙ্গে মৌয়ের আত্মার সম্পর্ক। এরই মধ্যে বিয়ে করেছেন অভিনয়শিল্পী ও পরিচালক জাহিদ হাসানকে, দুই সন্তানকে সময় দিচ্ছেন, নাচ-অভিনয় করছেন, অফিস চালাচ্ছেন। তবে রাত নয়টা থেকে ১১টা পর্যন্ত সময়টি তাঁর একেবারেই নিজের। এই সময়ে সূচিকর্ম, কাছের মানুষদের সঙ্গে ফোনে কথা বলা, গান শোনা, ভালো ছবি হলে দেখে ফেলা—এটাই তাঁর কাজ। এই দুই ঘণ্টা আসলে নিজের মতো করে বেঁচে থাকা। অন্য সময়গুলোতে সবার সঙ্গে মিশে যাওয়া।
কোমল বিকেলে মৌয়ের অফিসঘরে বসে শুরু হলো আলাপ-সালাপ।
বলে রাখা ভালো, সাড়ে তিন বছর বয়সে যখন স্কুলে ভর্তি হলেন, তখনই মৌকে নাচের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন মা রাশা ইসলাম। নানা আজফার হাসান মাহমুদ ছিলেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী। রবীন্দ্রনাথের ছাত্র ছিলেন তিনি। ফলে রাশা ইসলামের মধ্যেও রবীন্দ্রপ্রেম ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। মৌয়ের বাবা সাইফুল ইসলামও ছিলেন সাংস্কৃতিক পরিবার থেকে আসা একজন মানুষ। মৌয়ের ভাষায়, ‘আমার চোখে আমার বাবা ছিলেন প্রকৃত অর্থে তেমন শিল্পী, যিনি কখনোই তাঁর শিল্পকে বিক্রি করেননি। তিনি নিজের জন্যই গান করেছেন।’ মৌ যে এই সাংস্কৃতিক বলয়ের মধ্যেই বিকশিত হবেন, সেটা বিলক্ষণ বোঝা যায়। তাই আমাদের প্রথম প্রশ্নটিই হয় এ রকম—
ছোটবেলা থেকেই নাচ শিখছেন? ভালো লাগত?
রাগ হতো তখন। আমাকে মায়ের ইচ্ছায় জোর করে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি হতে হলো। দুর্ভাগ্য, এখন সেটা ভেঙে গেছে। আমি তখন ক্লাসে যেতে চাইতাম না। আমি এখন যে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছি, সেটার নাম বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস (বাফা)। আমরা চার বোন। চার বোনকেই কোনো না কোনোভাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত করেছেন মা। আমার গুরু রাহিজা খানম ঝুনু, কবিরুল ইসলাম রতনের কাছে ধীরে ধীরে নাচ শিখেছি। ছোট থেকেই আমরা দলীয় নাচে অংশ নিতাম। চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, মায়ার খেলা, চণ্ডালিকা করেছি। ১৯৯১ বা ৯২ সালে রাহিজা খানম ঝুনু আমাকে দিয়ে নকশীকাঁথার মাঠ-এর সাজু চরিত্রটি করালেন। আমার এখনো মনে পড়ে, যতবার মহড়া করতে যেতাম, ঝুনু আন্টি টেবিল-চেয়ার ছেড়ে এসে দেখিয়ে দিতেন। ঝুনু আন্টি তো এই চরিত্র করে একসময় আলোড়ন তুলেছিলেন। তিনি কেন আমার মধ্যে সাজুকে দেখতে পেয়েছেন, তা আমি জানি না। এরপর একসময় ‘শ্যামা’ চরিত্রটি করার প্রস্তাব এল। আমার নানা ও বাবা-মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল, আমি রবীন্দ্রনাথের কোনো চরিত্র করি। কিন্তু আফসোস, যখন আমি ‘শ্যামা’র মূল চরিত্রটি পেলাম, তখন আমার নানার চোখের ছানি অপারেশন হচ্ছে। তিনি দেখতে আসতে পারলেন না। তিনি বললেন, ‘আমি জানি, তুমি যখন শ্যামা করবে, তখন পত্রিকায় অনেক ছবি আসবে, ফিচার আসবে। তুমি এসে আমাকে পড়ে শোনাবে।’ পরদিন সত্যিই আমাকে সব কটি পত্রিকা নিয়ে তাঁকে পড়ে শোনাতে হলো। বলতে চাই, নানা-বাবা ও মায়ের কারণেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি এক ধরনের প্রেম ছিল আমার মধ্যেও, কিন্তু এত বোঝার ক্ষমতা ছিল না। রবীন্দ্রনাথকে বোঝা তো খুব বড় একটা ব্যাপার। ইংরেজি মাধ্যমে পড়তাম, তাই বাংলায় একটু দুর্বলতা তো ছিলই। তার পরও পড়ে বুঝতে চেষ্টা করেছি। মঞ্চে তখন খুব কষ্ট করে চোখে পানি আনতে হতো। এখন যখন ‘শ্যামা’ করি, তখন মনে হয়, আমিই শ্যামা। আশা করি, ভবিষ্যতে ‘শ্যামা’ চরিত্রের আরও গভীরে যেতে পারব। শেখার তো শেষ নেই। আমার সেরাটা এখনো দিতে পারিনি।
শ্যামার কোন জায়গায় সবচেয়ে কঠিন মনে হয়?
‘শ্যামা’র অনেক জায়গাতেই পৌঁছানো খুব কঠিন। উত্তীয়কে আংটি দিয়ে যখন শ্যামা আশীর্বাদ করে, তখন সেটা খুবই কঠিন অনুভূতির জায়গা। একজন মেয়ে তার ভালোবাসার জন্য অন্য একজনকে যখন উত্সর্গ করে, তখন সেটা ফুটিয়ে তোলা খুবই কঠিন ব্যাপার, কষ্টের ব্যাপার। যখন বজ্রসেন শ্যামাকে প্রশ্ন করে, সেটা এক ধরনের কষ্ট, যখন ধিক্কার দেয়, সেটাও অনেক কষ্টের। সবকিছু ছেড়ে যখন শ্যামা আসে বজ্রসেনের কাছে, বজ্রসেন তাকে গ্রহণ করে না, সে দৃশ্যও কষ্টের—আসলেই বলা যাবে না, এতটা গভীরতায় এখনো ঢুকতে পেরেছি কি না। এটা এত সহজ নয়।
শ্যামা ঠিক করছে না—এমন কথা কি মনে হয়?
যখন ছোট ছিলাম, অবিবাহিত ছিলাম, তখন রাগ হতো শ্যামার প্রতি। প্রশ্ন জাগত, কেন ও এ রকম করবে? কেন যে ছেলেকে (উত্তীয়) অগ্রাহ্য করে এসেছে সব সময়, তাকেই ব্যবহার করছে? আমার মন বলে, কখনো কাউকে ছোট চোখে দেখতে নেই। নিজের কারণেই কিন্তু শ্যামার জীবনটা এ রকম ছারখার হয়ে যায়। ছেলেটা কিন্তু শ্যামাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেই গেছে। কিন্তু এখন মনে হয়, মানুষের জীবন এ রকম হতেই পারে। একটা কথা আছে না, ভালোবাসা আর যুদ্ধে ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই? প্রেমের জন্য একজন মানুষ অবশ্যই নিজের অনেক কিছুকেই পরিবর্তিত করতে পারে।
স্কুল থেকেই নাচ। ভালো লাগত?
স্কুলে যখন শিক্ষক মিসেস হক বলতেন, ‘সেগুফতা (আমার মেজো বোন), সাদিয়া, তোমরা এসো, মহড়া করতে হবে।’ ভীষণ রাগ হতো তখন! সবাই বরফ-পানি খেলছে, আমরা দুই বোন খেলতে পারব না! এখন বুঝি, এগুলোই আমাদের তৈরি করেছে। মিসেস হক সব সময়ই সব ব্যাপারে আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। সরকারি প্রতিনিধি হয়ে যখন সিউল, পিয়ংইয়ংসহ বিভিন্ন দেশে গিয়েছি, ভালো লেগেছে। আমাদের স্কুল থেকে একটি মেয়ে সরকারি সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে যাচ্ছে, তাতে শিক্ষকদেরও গর্ব হতো। সে দিনগুলো সত্যিই ছিল অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথের চরিত্রগুলো তো নিজের অনুভূতির সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হয়। সে বোঝাপড়ায় কারও সাহায্য পেয়েছেন?
ঝুনু আন্টি বুঝিয়ে দিয়েছেন। পড়ে কিছুটা বুঝেছি। রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলো মন দিয়ে পড়লে, গানগুলো মন দিয়ে শুনলে বোঝা যাবে, তাঁর লেখাতেই সবকিছুর ইঙ্গিত রয়েছে। স্পষ্ট বলে দেওয়া আছে, কে কোথায় কী পোশাক পরবে, কে কোন ধরনে নাচবে। মনে হয়, যত দিন যাচ্ছে, জিনিসগুলো যেন আরও স্পষ্ট করে বুঝতে পারছি। এখন প্রতিটা পঙিক্ত বোঝার চেষ্টা করি। আগে যখন গ্রুপে নাচতাম, হয়তো গান বেজে যেত। বলে দেওয়া হতো, হাসো, হাসতাম; কাঁদো, কাঁদতাম। এখন যখন মূল চরিত্রটি করি, তখন উপলব্ধি থেকেই করি। যখন ‘প্রেমের জোয়ারে ভাসাব দোহারে’ কিংবা ‘কী করিয়া সাধিলে অসাধ্য ব্রত’ গানগুলো হয়, তখন আমি কিন্তু তা অনুভব করি। আমি ভেতরে ভেতরে পুরো সময়টাই গান করতে থাকি। অনুভূতির প্রকাশ অনেক বেশি নির্ভর করে সহশিল্পীর অনুভূতির ওপর। শ্যামার শেষ দৃশ্য আমি আর রতন ভাই কখনো মহড়া করিনি। শুধু মঞ্চে কখন কে কোথায় যাব, সেই ব্লকিংটা করেছি। আমার অনেক কিছু সহজ হয়ে যায়, যখন ওর দিকে তাকাই। রতন ভাই শেষ দৃশ্যটায় যে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলেন, চরিত্রের যত গভীরে ঢোকেন, তাতে তাঁর দিকে তাকালে আমাকে কিছুই করতে হয় না, চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি বেরিয়ে আসে। আমি তখন মনে করি, সেই আমার সব। আমার জীবনের প্রথম নৃত্যনাট্য নকশীকাঁথার মাঠ। তাতে রূপাই চরিত্রটি করতেন (এখনো করেন) আবদুর রশীদ স্বপন। নৃত্যনাট্যটিতে এক জায়গায় বর্তমান ও অতীতের দুটি দৃশ্য খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেখানো হতো। মঞ্চ থেকে বের হয়ে কাপড় বদলে খুব দ্রুত মঞ্চে যেতে হতো। তখন আমি চিত্কার করে বলতাম, ছাড়, আমাকে ছাড়, আমাকে ডাকে। কাপড় পরিবর্তনের ওই ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই বন্ধুরা বলত, কে তোকে ডাকে? বলে যা, কে ডাকে। আমি তখন চরিত্রটির ভেতরে এমনভাবে স্থিত হতাম যে মনে হতো, জীবনে সবচেয়ে বেশি যাকে আমার ভালো লাগে, সে-ই আমাকে মঞ্চে ডাকছে। আমি যখন নাটকে কাজ করি, তখন এতটা একাত্ম হতে পারি না। তবে এখন আমি সেটা শুরু করেছি। চেষ্টা করছি। নাচের মধ্যে চরিত্রে ঢোকার ক্ষেত্রে এখনো একাগ্রতা কাজ করে।
এই একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য কার প্রতি আপনি কৃতজ্ঞ?
আপনি এ কথাটি লিখলে আমি খুশি হব, যা কখনো মাকে বলা হয়নি। এখন মনে হয়, প্রতিমুহূর্তে মাকে গিয়ে বলি—মা, আমি আজকে যা, তা তোমার জন্য। নাচ শিখতে হবে—জোর করে ভর্তি করে দিলেন তিনি। মডেলিং করার সময় পরিবারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় মেয়েদের। কিন্তু আমার জন্য সে রকম কোনো সমস্যাই ছিল না। আমার চেয়েও আমার বাবা-মা আধুনিক, তাই সমস্যা হয়নি। কোনো কিছুর জন্যই আমাকে লড়তে হয়নি। মডেলিংয়ের জন্য গীতিআরা চম্পা আন্টি বলেছিলেন, ‘আপা, তোমার মেয়েটাকে দিয়ে যাও।’ মা বলেছিলেন, ‘নিয়ে নে।’ আমার মা, ঝুনু আন্টি, গীতিআরা চম্পা আন্টির কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আরও অনেকেই আছেন, তবে এই তিনজনের ঋণ শোধ হওয়ার নয়।
বর্তমান সময়, নাটক, এ সময়কার ব্যস্ততা, অস্থিরতা নিয়েও অনেক কথা হয় আমাদের। কিন্তু আমরা থাকতে চাই রবীন্দ্রনাথের শ্যামার কাছাকাছি। মৌ এখনো নৃত্যনাট্য উপস্থাপন করে চলেছেন। শিল্পের সভায় এখনো হাজির হচ্ছেন নান্দনিক কোমলতা নিয়ে, সে জায়গাতেই আমরা থামি।

No comments

Powered by Blogger.