আইএসআইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন কেন?

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৯১ সালে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) কাছ থেকে খালেদা জিয়া পাঁচ কোটি রুপি নিয়ে নির্বাচন করেছেন। এই টাকা নেওয়ার জন্য তাঁকে জবাব দিতে হবে।


'যুদ্ধাপরাধীদের' বিচারের দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, 'যারা দেশের মানুষের রক্ত ঝরিয়েছে, মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে, তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হবেই। যতই চেষ্টা করুন, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে পারবেন না।' যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে দেশের গণতন্ত্রকামী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ উপলক্ষে গতকাল বুধবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের শোভাযাত্রা-পূর্ব এক সমাবেশে শেখ হাসিনা এ আহ্বান জানান। ভাষণ শেষে তিনি শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন। লক্ষাধিক লোকের অংশগ্রহণে ক্ষমতাসীন দল আয়োজিত এই শোভাযাত্রায় একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি ওঠে।
শোভাযাত্রায় বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি দেখে খুশি শেখ হাসিনা। বক্তব্যে তিনি বলেন, 'আজকে সারা ঢাকা শহরে মানুষের ঢল নেমেছে।'
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু ভবন পর্যন্ত শোভাযাত্রা হওয়ার কথা থাকলেও জনসমাগম ছড়িয়ে পড়ে নিউ মার্কেট, পল্টন, কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর সর্বত্র। শাসক দলের এই শোভাযাত্রার কারণে ঢাকাজুড়েই দেখা দেয় যানজট।
বিরোধীদলীয় নেতার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। উনি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চান। কিন্তু যতই চেষ্টা করুন না কেন, তাদের বাঁচাতে পারবেন না। বাংলার মাটিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হবেই হবে। রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। এই স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেব না।'
মার্চে রাজাকারদের ঠাঁই নেই : বিএনপির ১২ মার্চের 'ঢাকা চলো' কর্মসূচি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, 'মার্চ মুক্তিযুদ্ধের মাস, স্বাধীনতার মাস। এ মাসকেই তিনি (খালেদা) বেছে নিয়েছেন। কিন্তু মার্চে রাজাকারদের ঠাঁই বাংলার মাটিতে নেই। এর আগে উনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। আবার তিনি স্বাধীনতার মাসকে বেছে নিয়েছেন স্বাধীনতার শত্রুদের খুশি করতে।'
যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে পারবেন না : প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'যখন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, তখন থেকেই বিরোধীদলীয় নেতার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তবে যতই ষড়যন্ত্র করুন না কেন, যুদ্ধাপরাধীদের কেউ রক্ষা করতে পারবেন না।'
আইএসআইয়ের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জবাব দিতে হবে : খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের কাছে দেশ বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ উত্থাপন করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের কাছ থেকে খালেদা জিয়া পাঁচ কোটি রুপি নিয়ে নির্বাচন করেছেন। পাকিস্তানের আদালতে তা ফাঁস হয়ে গেছে। তিনি বলেন, '১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে যাদের আমরা পরাজিত করেছি, সেই পরাজিত শক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেশ বিক্রি করেছেন খালেদা জিয়া। এ জন্য বাংলার মানুষ তাঁকে ক্ষমা করবে না। কেন টাকা নিয়েছেন তার জবাব তাঁকে দিতে হবে। বাংলার মানুষ সেই জবাব আদায় করে নেবে।'
আইএসআই খালেদা জিয়াকে পাঁচ কোটি রুপি দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করতে আইএসআই খালেদা জিয়াকে এ অর্থ দেয় বলে দুবাই থেকে প্রকাশিত খালিজ টাইমস এক প্রতিবেদনে এ তথ্য দিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক উনাকে কোলে তুলে ক্ষমতায় বসাবে না : প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিন বছরে বেশ কিছু নির্বাচন হয়েছে। আল্লাহর রহমতে একটা নির্বাচনেও কোনো কারচুপি হয় নাই। অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মানুষ কিছু পায়। আর বিএনপি ক্ষমতায় আসে লুট করতে, মানি লন্ডারিং করতে।' তিনি বলেন, 'উনি (খালেদা) কী ভেবেছেন, তত্ত্বাবধায়ক এলে ওনাকে একেবারে কোলে তুলে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে! ওনাকে তো কোলে তুলে ক্ষমতায় বসাবে না। কিন্তু ওনার বোঝা উচিত, তত্ত্বাবধায়ক ওনার দুই ছেলেকে উত্তমমধ্যম দিয়ে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল। আর এবার যদি তত্ত্বাবধায়ক আসে, তাহলে তাঁদের ধরে এনে কারাগারে পুরবে। সেটা ওনার মনে রাখা উচিত।'
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলের দুর্বিষহ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'সেই সময় ১৪-১৫ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। ৭০০ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। যে নির্যাতন, লুটপাট, অগি্নসংযোগ, মানি লন্ডারিং হয়েছিল সেই সময়ে, তা বাংলার মানুষ ভোলেনি। তাঁরাই আবার বড় কথা বলেন।'
সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিরোধীদলীয় নেতাকে আইএসআইয়ের দালাল ও 'পেইড এজেন্ট' হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে তাদের পক্ষ নিয়েছেন। সরকার যাতে বিচার শেষ করতে না পারে সে জন্য ষড়যন্ত্র করছেন।'
বিএনপিকে তাদের প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আসার আহ্বান জানিয়ে সৈয়দ আশরাফ বলেন, 'সংসদে আসুন। আগামী নির্বাচন কিভাবে হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকলে সেটা তুলে ধরুন। সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে।'
সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে সমাবেশে আরো বক্তব্য দেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, মোহাম্মদ নাসিম, এম এ আজিজ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম প্রমুখ।
লক্ষাধিক মানুষের অংশগ্রহণ এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ততায় আওয়ামী লীগের শোভাযাত্রা হয়ে ওঠে গণমানুষের মিলনমেলা। শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে মৎস্য ভবন, হাইকোর্ট, প্রেসক্লাব, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, লালবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রূপসী বাংলা হোটেল মোড়, বাংলা মোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট পর্যন্ত জনতার ঢল নামে। শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচারের দাবি।
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, যুব মহিলা লীগ, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের সব সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শোভাযাত্রায় যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সংগঠন এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষও এতে অংশ নেয়। সামনে থেকে শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা।
শোভাযাত্রায় মুক্তিযুদ্ধের জাগরণের গান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ৪১ বছর পরেও কিছু সময়ের জন্য সবাইকে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের সেই অগি্নঝরা দিনগুলোতে। হাতে বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে সমবেত জনতা শ্রদ্ধা জানায় স্বাধীনতাযুদ্ধের মহানায়ককে।
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে শুরু হওয়া শোভাযাত্রা শাহবাগ, কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, কলাবাগান হয়ে জাতির জনকের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে গিয়ে শেষ হয়।
বাংলাদেশের মানচিত্র-সংবলিত ছোট পতাকা বাঁধা ছিল অনেকের হাতে ও মাথায়। হাতে ছিল 'যুদ্ধাপরাধীদের' বিচারের দাবি-সংবলিত প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকা, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি। খোলা ট্রাকের ওপর মঞ্চ বসিয়ে চলেছে সংস্কৃতিকর্মীদের গান-বাজনা। মানুষের পাশাপাশি সমাবেশে বর্ণিল সাজে হাতির উপস্থিতিও লক্ষ করা গেছে। এ ছাড়া গরুর গাড়ি, ঘোড়া, বিশাল আকৃতির নৌকা, লাল-সবুজের পতাকাও দেখা গেছে।
বরাবর ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সভা-সেমিনারের মাধ্যমে পালন করা হলেও এবার বিশাল শোভাযাত্রার মাধ্যমে পালন করা হলো। রাজনৈতিকভাবে এ শোভাযাত্রা বিএনপির কর্মসূচির আগে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনের একটি কৌশল।

No comments

Powered by Blogger.