বীরকন্যা প্রীতিলতার পথ ধরে... by আবুল মোমেন

চট্টগ্রাম রক্ষণশীল এলাকা হিসেবেই পরিচিত। এখানকার সব সম্প্রদায়ের মানুষ সম্পর্কেই এ কথা ভাবা হয়। এমন একটি জনপদে নারীরা সমাজকর্মে বা রাজনীতিতে এগিয়ে আসবেন এমনটা ভাবা যায় না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নারীরা এসব দায়িত্ব পালনে পিছিয়ে থাকেননি। এ কালের নারীদের কথা এলে প্রথমেই মনে পড়বে বীরকন্যা প্রীতিলতার কথা।


সারা ভারতবর্ষে তিনি এক নামে পরিচিত। সেই ১৯৩০-এর দশকে তরুণী প্রীতিলতা মাস্টারদার বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গোপন সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামে যুক্ত হয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের বিপ্লবী তরুণী নিরাপদ চাকরি আর সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন বাদ দিয়ে গোপন জীবন, অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
প্রীতিলতার প্রদর্শিত পথে এগিয়ে আসেন বিপ্লবী কল্পনা দত্ত ও কুন্দপ্রভা সেন, সাবিত্রী দেবীসহ আরও অনেকে।
ব্রিটিশ আমলে কংগ্রেস নেত্রী ছিলেন চট্টগ্রামের বধূ ভারতবিখ্যাত কংগ্রেস নেতা দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের ইংরেজ ঘরনি নেলী সেনগুপ্তা। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামের আরেক বধূ কবি বেগম সুফিয়া কামাল নারীনেত্রী হিসেবে খ্যাত হয়েছেন।
মুসলিম সমাজে অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছে আরও। কিন্তু প্রীতিলতার আত্মত্যাগ ও বীরত্ব সবার মনে প্রেরণা সঞ্চারিত করেছে। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে হিন্দুসম্প্রদায়ের অনেক পরিবারে নারীশিক্ষা ব্যাপকতা লাভ করে। পাশাপাশি মুসলিম সমাজে জাগরণের সূচনা হয়। চল্লিশের দশকে উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ক্রমে তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় শুরু হয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, আর তারই রেশ ধরে হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একই সময়ে শুরু হয় স্মরণকালের ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ। এই পটভূমিতে রাজনীতিসচেতন পরিবারের নারীদের মধ্যে সমাজসচেতনতা সৃষ্টি হয়। অনেকেই দুস্থ মানুষের সেবায় এগিয়ে আসেন। মুসলিম লীগের তৎপরতা, জিন্নাহর চৌকস ভাবমূর্তি বাঙালি মুসলিম সমাজেও জাগরণ সৃষ্টি করেছে। তার ফলে মুসলিম পরিবার থেকেও নারীরা সমাজকর্ম ও রাজনীতিতে এগিয়ে আসতে শুরু করেন।
পাকিস্তানের প্রথম পর্বে আইনসভার সদস্য হয়েছিলেন নেলী সেনগুপ্তা ও তোহফাতুন্নেসা আজিম। পরবর্তীকালে ডা. নূরুন্নাহার জহুর (জহুর আহমদ চৌধুরীর স্ত্রী), রোকেয়া ইউসুফ, কামরুন নাহার জাফর রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এর মধ্যে কামরুন নাহার জাফর বিএনপি থেকে জেনারেল জিয়ার আমলে মন্ত্রী হয়েছিলেন।
ব্যাপক সামাজিক জাগরণের পটভূমিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় এ আমলে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক হবে বলে আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক সেভাবে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়েনি। নীলুফার কায়সার (প্রয়াত), হাসিনা মান্নান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দীর্ঘকাল সক্রিয়। পাকিস্তান আমলের শক্তিশালী বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে এসেছিলেন হান্নানা বেগম। পরে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যান। সামরিক কর্মকর্তাদের সীমিত গণতন্ত্রের যুগে যেসব নারী রাজনীতিতে আসেন তাঁদের মধ্যে কামরুনাহার জাফর ছাড়াও রোজী কবির, চেমন আরা তৈয়ব, নূর ই সাফার নামও উল্লেখ করতে হয়।
এখন গণতান্ত্রিক আমলে আওয়ামী লীগ বিএনপি উভয় দলেই বেশ কিছু নারী রাজনীতিক রয়েছেন। তবে বর্তমানে জাতীয় রাজনীতিতে সামগ্রিকভাবে চট্টগ্রামের যে শূন্যতা ও দুর্বলতা চলছে তার ছাপ নারীর ক্ষেত্রেও বহাল।
সাম্প্রতিককালে করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে বেশ কিছু মহিলা রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। চট্টগ্রামের কন্যা এককালের জনপ্রিয় নায়িকা কবরী নারায়ণগঞ্জ থেকে সরাসরি নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছেন। আবার এককালে চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয় চট্টগ্রামের বধূ সাজেদা চৌধুরী সংসদের উপনেতা হিসেবে আওয়ামী লীগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছেন। কিন্তু কি কেন্দ্রে কি জেলায় কোনো অবস্থান থেকেই নারী নেত্রীদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম তার উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সেবা লাভ করছে না। এক অর্থে বলা যায় রাজনীতিতে নারীর ভূমিকায় যথেষ্ট শূন্যতা রয়েছে। বলা যায়, মেধাবী, উদ্যমী, রাজনীতি সচেতন নারীর জন্য চট্টগ্রাম আজ আকর্ষণীয় কর্মক্ষেত্র। আমরা আশা করব যোগ্য নারীরা শূন্যতা পূরণে এগিয়ে এসে রাজনীতিতে সক্রিয় নারীশক্তিকে আরও জোরদার ও বেগবান করবেন।

No comments

Powered by Blogger.