ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস-জাতীয় উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় by হারুন-অর-রশিদ

মানুষে মানুষে ঐক্য, দেশ ও দশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা খোদ জাতি এবং পরিণতিতে জাতি-রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এ কথা সর্বজনবিদিত, ১৯৪৮ ও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিভূমি রচনা করে। ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অগ্রণী ভূমিকা ছিল, কলাভবনের সামনে অবস্থিত ‘অপরাজেয় বাংলা’ তারই স্বাক্ষর বহন করছে। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এখানেই ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয়।
শিক্ষা নিজেকে, সমাজকে জানতে ও বুঝতে, মানুষকে অধিকতর মানবিক, অন্যের মতের প্রতি সংবেদনশীল, সত্যনিষ্ঠ, সর্বজনীন বা সেক্যুলার, স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, কুসংস্কারমুক্ত, বিজ্ঞানমনস্ক, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সচেতন হতে শেখায়।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধানত তিনটি ধাপ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যমান। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায়ও এরূপ স্তরবিন্যাস বিদ্যমান ছিল। উচ্চশিক্ষা নানা দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। তবে শিক্ষাব্যবস্থার অপর দুই স্তরকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সাধারণ অর্থে শিক্ষার ক্ষেত্রে এ দুই স্তরের অবস্থান হচ্ছে একটি ইমারতের ভিত্তি বা ফাউন্ডেশনস্বরূপ। এর পরও বলতে হয়, উচ্চশিক্ষাই হচ্ছে একটি জাতির উন্নয়নের সোপান।
জাতির উন্নয়ন বলতে সাধারণত একটি জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বোঝায়। একটি জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত সমুদয় উন্নতি-সমৃদ্ধি এর অন্তর্ভুক্ত। আর উন্নয়নের জন্য আবশ্যক, জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন এবং বিজ্ঞান ও উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার। নতুন তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানব জাতির ইতিহাসে কি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায়, ইউরোপের রেনেসাঁ ও অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লব আমাদের সম্মুখে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শুধু এ অঞ্চলে নয়, বিশ্বজুড়ে রয়েছে এর খ্যাতি। জ্ঞান আহরণ, জ্ঞান সৃষ্টি ও জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় উন্নয়নে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবদান সর্বজনবিদিত। শুধু জাতীয় উন্নয়ন বলি কেন, বিশ্ব জ্ঞান ও ভান্ডারেও রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এস এন বোস বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে ‘কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিকস তত্ত্ব’ প্রণয়ন করেন (১৯২৪), যা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বহু অজানা বিষয় জানতে, ব্যাখ্যা করতে সুযোগ এনে দিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আমাদের দেশের বিজ্ঞানী অধ্যাপক মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান ও অধ্যাপক জেবা ইসলাম সিরাজ এঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় (যাঁদের মধ্যে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগ এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা অন্তর্ভুক্ত) পাটের জন্ম-রহস্য (জিনম সিকোয়েন্সিং) আবিষ্কার করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের এ আবিষ্কার ‘সোনালি আঁশ’ পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে এনে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে দৃঢ়বিশ্বাস।
আমাদের দেশের বর্তমান উন্নয়ন চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার অধিক হার, শিশুমৃত্যুর উচ্চহার, মাতৃত্বকালীন মৃত্যু, জনগণের জন্য উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জ্বালানির নতুন উৎস সন্ধান, শিল্পায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে, এর বিশেষায়িত বিভাগ, ইনস্টিটিউট, সেন্টার যথা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি, মাইক্রোবায়োলজি, অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ, ভূতত্ত্ব, ফার্মেসি অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো, সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সায়েন্সেস, পপুলেশন সায়েন্সেস, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, নাট্যকলা, সংগীত, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট, নব প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদ, দুর্যোগ গবেষণা প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
মনে রাখতে হবে, শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। জ্ঞানচর্চার চিরায়ত ধারার পাশাপাশি মানবিকতা বা নৈতিকতাবোধের বিকাশ ও জাতীয় উন্নয়নই হওয়া উচিত আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও আদর্শ। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রতি আমাদের বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। গুণ ও মানসম্পন্ন এবং সৃষ্টিশীল উচ্চশিক্ষাই পারে একটি জাতির মোড় ঘোরাতে। আমাদের শিক্ষা-গবেষণা হতে হবে বিশ্বমানের। সৃষ্টি করতে হবে বিশ্বমানের গ্র্যাজুয়েটস। এ জন্য থাকা চাই আধুনিক ও পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা। সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়কে নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। হলে হলে সাইবার সেন্টার প্রতিষ্ঠাসহ ছাত্রছাত্রীদের প্রতিটি কক্ষে ইন্টারনেটের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিকে সম্পূর্ণ অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশনের আওতায় আনতে হবে। ই-বুক, ই-জার্নালের প্রাপ্ততা পর্যাপ্ত করতে হবে। শ্রেণীকক্ষগুলোকে ইন্টারনেটে, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দিয়ে সজ্জিত করতে হবে। বিদেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গবেষণাগারে আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য গবেষণা সামগ্রী ও উপকরণ থাকা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ থাকতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হবেন রাষ্ট্রক্ষমতা বা বিত্তবান হওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত শুধুই জ্ঞান আর গবেষণাকর্মে নিবেদিতপ্রাণ, অন্য কথায় সম্পূর্ণ প্রফেশনাল।
উচ্চশিক্ষাকে ঘিরে জাতির উন্নয়নের ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ও বহুসংখ্যক প্রশিক্ষিত শিক্ষক-গবেষক রয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এর পক্ষেই উন্নয়নের এই লক্ষ্য অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন সম্ভব। অতএব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বীকৃতির দাবি রাখে।
অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ: উপ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.