ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি-অতি মুনাফার গ্রাসে সেবাবাণিজ্য

কোনো নিয়মনীতির বালাই নেই। নেই আগাম জানিয়ে দেওয়ার তাগিদ। বাজারে সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে সৃষ্টি করা হচ্ছে কৃত্রিম সংকট। এরপর বাড়ানো হচ্ছে দাম। প্রান্তিক ভোক্তাকেই বহন করতে হচ্ছে বাড়তি দামের চাপ। দশটা সাধারণ ব্যবসায়ে একসময় পণ্যের দাম বাড়াতে এই কৌশল নেওয়া হতো।


এখন ওষুধের ব্যবসার মতো সেবাবাণিজ্যও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী চক্রের পথ অনুসরণ করতে যাচ্ছে। গত কয়েক দিনে ঢাকাসহ সারা দেশে ওষুধের দাম যে হারে বাড়ানো হয়েছে, তাতে এই সেবাবাণিজ্যটিকে এখন আর অন্য দশটা ব্যবসা থেকে আলাদা করে দেখা যাচ্ছে না।
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র ওষুধের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। একটি পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে ওষুধের দাম ২০০ গুণেরও বেশি বেড়েছে। ওষুধের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটা বিশ্বরেকর্ড। ওষুধের ব্যবসা যাঁরা করেন, তাঁদের কিংবা ওষুধ প্রস্তুতকারীদের কাছ থেকে অন্য ব্যবসায়ীদের মতো আচরণ কাম্য হতে পারে না। ওষুধ ব্যবসা অন্য ব্যবসার চেয়ে আলাদা। এ ব্যবসাটি অন্য ব্যবসার মতো শুধুই ব্যবসা নয়, এখানে ব্যবসার পাশাপাশি সেবার দিকটিও দেখতে হয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এখানে ওষুধের ব্যবসাতেও অসাধু ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বাংলাদেশে এখন আন্তর্জাতিক মানের অনেক ওষুধ তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। আবার, একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে তৈরি করছে নিম্ন্নমানের ওষুধ। সেই ওষুুধ সেবন করলে অনেক ক্ষেত্রে জীবনহানির আশঙ্কাও থাকে। কিছুদিন আগে দেশের একটি ওষুধ কম্পানির তৈরি ওষুধ সেবনে শিশুমৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
মানতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি সন্তোষজনকভাবে স্থিতিশীল নয়। ডলারের দামের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। আমদানিনির্ভর খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়ে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া অস্বাভাকি নয়। কিন্তু দাম যখন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তখন প্রস্তুতকারকদের সততার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। অতি মুনাফার লোভ এই সেবাবাণিজ্যটিকে কলুষিত করছে কি না, সে প্রশ্নটাও এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। কারণ, ওষুধ প্রস্তুতকারীরা ওষুধের দাম বাড়ানোর আগে বাজারে নির্দিষ্ট ওষুধের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। কোনো কোনো সময় কম্পানি গণহারে সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামে। ওষুধের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও সেই প্রতিযোগিতা কিছুটা হলেও চোখে পড়েছে। এবারে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্য কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। সাধারণ ক্রেতার কাছে যেটা বর্ধিত মূল্য, সেটাই প্রস্তুতকারকদের কাছে সমন্বয়। ওষুধের দাম কিছুটা সমন্বয় করা হয়েছে, এমনটাই বলতে চাইছেন ওষুধ প্রস্তুতকারীরা। এই সমন্বয়ের দিকটি দেখার জন্য সরকারের নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সেই প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিষ্ঠানটির সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সেটা অবান্তর হবে না। আবার, এই প্রতিষ্ঠানটির কাজের পরিধিও সীমাবদ্ধ। সেই সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে অসাধু চক্র বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিজেদের ঘরে অধিক মুনাফা তোলার চেষ্টা করবে না, এ নিশ্চয়তা নেই।
স্বাভাবিক কারণেই ক্রেতাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে ওষুধ প্রস্তুতকারী কম্পানিগুলোর ওপর। ওষুধের ব্যবসা অন্য দশটা ব্যবসার মতো নয়। সেবাধর্মী এই ব্যবসাটি নির্ভর করে নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার ওপর। সেটা না থাকলে ব্যবসাটি আর সেবাবাণিজ্য থাকে না। আগে থেকে না জানিয়ে, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ওষুধের দাম বাড়ানোর এ প্রবণতা ওষুধ ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভকেই উদগ্র করে তোলে। অনেক সংকটাপন্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের দুশ্চিন্তা ও দুর্ভোগকে সীমাহীন করে তোলে। রাষ্ট্রের এদিকে জরুরি ভিত্তিতে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

No comments

Powered by Blogger.