নতুন চেহারায় বাংলাদেশের বোলিং by তারেক মাহমুদ

সেই ছবিটা এবার সম্ভবত কোথাও ছাপা হয়নি। অনুশীলনের ফাঁকে তিন স্পিনারের আড্ডা বা স্পিনারদের নিয়ে কোচের আলাদা ক্লাস। বাংলাদেশ দলের অনুশীলন থেকে পত্রিকার পাতায় এ ধরনের ছবি যায় দলটার স্পিন-নির্ভরতা বোঝাতে। এশিয়া কাপে ধরা পড়েনি সে রকম দৃশ্য।

প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই টুর্নামেন্টে ছবিটা গুরুত্বহীনও। এশিয়া কাপে বাংলাদেশ শুধু স্পিনারদের দল নয়, তিন পেসারের দলও। টানা তিন ম্যাচে তিন পেসারের ব্যতিক্রমধর্মী ‘টিম কম্বিনেশন’ এর আগে খুব কি দেখা গেছে? তিন পেসার নিয়ে সাফল্য পাওয়াটাও ব্যতিক্রম। মাশরাফি বিন মুর্তজার দারুণ প্রত্যাবর্তন, কিছুটা খরুচে হলেও প্রথম ম্যাচে শাহাদাত হোসেনের ৩ উইকেট আর সময়মতো ব্রেক থ্রু দিতে পারা, সুযোগ পেয়ে কাল নাজমুল হোসেনের আগুন ঝরানো—এশিয়া কাপে পেসারদের সাফল্যের জয়গানই শোনাচ্ছে। হাহাকার কেবল শফিউল ইসলামকে নিয়ে। ভারত ম্যাচে কাঁধের চোটে মাঠ ত্যাগ আশঙ্কা জাগাচ্ছে তাঁকে লম্বা সময়ের জন্য হারানোর।
ভয়টা রুবেল হোসেনকে নিয়েও। দুই পেসারের লম্বা সময়ের জন্য খেলার বাইরে চলে যাওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটকে পেসার-সংকটে ফেলতে পারে। তবে সংকটকালের আশঙ্কার মধ্যে তিন পেসার নীতির সার্থকতা প্রমাণ কিছুটা হলেও আলো জ্বালিয়ে রাখছে। এশিয়া কাপ বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণটাকে বুঝি নতুন করেই চেনাল!
মিরপুরের উইকেট পেসারদের কখনোই ছিল না। ছিল না স্পিনারদেরও। তবে বল একটু ধীরে আসত বলে স্পিনাররাই সুবিধা পেত। কাল শ্রীলঙ্কা ইনিংসের সময় সেই চরিত্র কিছুটা ফুটে উঠলেও এশিয়া কাপের ম্যাচগুলোতে পুরোপুরি ব্যাটিং উইকেটের চেহারায় ছিল শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের ২২ গজ! উইকেটের সবুজভাব প্রেসবক্স থেকেও স্পষ্ট। জয়াবর্ধনে-মিসবাহরা তো বটেই, মুশফিক-সাকিবদের কাছেও ঘরের মাঠ বিস্ময় নিয়ে ধরা দিল। টুর্নামেন্টের সবচেয়ে উচ্চ তাপমাত্রার ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৩২৯ রান করে পাকিস্তানের হার শেরেবাংলার উইকেটকে আরও বেশি করে দিচ্ছে ব্যাটিং উইকেটের স্বীকৃতি।
এমন উইকেটে খেলা আর বোলারদের গুণগান! সাহসের কাজই। তাও আবার সেই বোলাররা করেন পেস বল, খেলেন বাংলাদেশ দলে। সাহস জোগাচ্ছে আসলে গত তিন ম্যাচে পেসারদের পারফরম্যান্স। প্রথম আর কালকের ম্যাচে ১ উইকেট করে পেয়েছেন, ভারতের বিপক্ষে ২ উইকেট। কিন্তু এশিয়া কাপে মাশরাফির বোলিং ঠিক উইকেটের সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যাবে না। ১১ মাস পর ফিরেও যে লাইন-লেংথের একটুও হেরফের হয়নি, সেটা তিনি দেখালেন।
কাল নাজমুল টুর্নামেন্টে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই পেলেন ৩ উইকেট। ৩২ রানের মধ্যে জয়াবর্ধনে, দিলশান আর সাঙ্গাকারাকে তুলে নিয়ে শ্রীলঙ্কা ইনিংসের কোমর ভেঙে দিয়েছেন তিনিই। মাশরাফির কৃতিত্ব ছায়ার মতো আছে এখানেও। নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে চাপে ফেলে দিয়েছিলেন বলেই না নাজমুলের সামনে নিয়ন্ত্রণ হারালেন জয়াবর্ধনে-দিলশানরা!
৮ ওভারে ৫১ রান দিয়ে কালও কিছুটা খরুচে শাহাদাতের বোলিং। তবে উপুল থারাঙ্গাকে ফেরানোটা সময়ের দাবি ছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় শ্রীলঙ্কাকে কম রানে আটকে রাখতে এই উইকেটের গুরুত্ব অনেক। ভারতের বিপক্ষে ১০ ওভারে ৮১ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকলেও তার আগের ম্যাচে পাকিস্তানকে চাপে ফেলে দিয়েছিলেন ৩ উইকেট নিয়ে। এর মধ্যে সেঞ্চুরির কাছাকাছি চলে যাওয়া মোহাম্মদ হাফিজের উইকেটও ছিল।
টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের স্পিনাররাও নিষ্প্রভ নন। ভারত ম্যাচ বাদ দিয়ে বাকি দুই ম্যাচেই দুটি করে উইকেট সাকিবের। তিন ম্যাচে ৪ উইকেট নিয়ে নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের পুরস্কার পেয়েছেন আরেক বাঁহাতি স্পিনার রাজ্জাকও। তবে বাংলাদেশের বোলিং মানেই বাঁহাতি স্পিনের আগ্রাসন, সেটা দেখা যায়নি এশিয়া কাপে। স্পিনারদের সঙ্গে ভাগ বসিয়েছেন পেসাররা। বাংলাদেশের পক্ষে টুর্নামেন্টে কাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ উইকেটের পরিসংখ্যানও তা-ই বলে। সর্বোচ্চ ৪ উইকেট করে পেয়েছেন মাশরাফি, সাকিব, রাজ্জাক, শাহাদাত চারজনই।
ব্যাটসম্যানদের উইকেটে ব্যাটসম্যানরাই ম্যাচ জেতাবেন। তবে কিছুটা দায়িত্ব তো বোলারদেরও আছে। শ্রীলঙ্কা ম্যাচের আগের দিন সেটাই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন মাশরাফি, ‘এখানে বোলারদের বোলিংয়ে বৈচিত্র্যের দিকেই বেশি তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। অনেক বড় বড় স্কোর হচ্ছে। এর মধ্যেও যদি বোলাররা ভালো বল করতে পারে, জেতাটা সহজ হয়। বোলাররা ভালো করতে পারলে প্রতিপক্ষকে ২৬০-২৭০ রানের মধ্যে আটকে রাখা সম্ভব। তাতে ব্যাটসম্যানদের কাজ সহজ হয়ে যায়।’
বাংলাদেশের বোলাররা কাল সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। বাকি কাজটুকু করে দিলেন ব্যাটসম্যানরা।

No comments

Powered by Blogger.