ধ্বংসের কিনার থেকে by সুভাষ সাহা

কী করে তিনি টিকে থাকলেন? শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে পাকিস্তানে কোনো বেসামরিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে চার চারটি বছর পার করে দেওয়া কি চাট্টিখানি কথা! বিশ্ববাসীর বিস্ময় বিস্ফারিত চর্ম চক্ষুর সামনে এই অসাধ্যকেই সাধন করে দেখালেন আসিফ আলী জারদারি। অথচ এক সময় এই লোকটির গায়ে মি. টেন পার্সেন্টের খেতাবটা মিডিয়া ও পরে জনতা জুড়ে

দিয়েছিল। তাই তিনি পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে কখনও তেমন গোনাগুনতির মধ্যে আসেননি। পাকিস্তানের ক্যারিশম্যাটিক লিডার তার স্ত্রী বেনজির ভুট্টো ২০০৭ সালে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী হত্যার শিকার হওয়ার পর এই ব্যক্তিটির কাঁধে যখন ভুট্টো পরিবারের দল পিপিপি ও দেশের দায়িত্ব এসে বর্তায়, তখনও কোথাও থেকে উচ্ছ্বসিত আশাবাদ লক্ষ্য করা যায়নি। সেনাবাহিনী তো তাকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট করার পক্ষেই ছিল না। অগত্যা তাকে মেনে নিতে বাধ্য হলেও শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব অপ্রত্যাশিতভাবে প্রেসিডেন্টের এখতিয়ার থেকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে সমর্পণ করার ব্যবস্থা করে তারা তার ব্যাপারে তাদের চূড়ান্ত উন্নাসিকতা প্রকাশ করে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে এহেন গুঁতাগুঁতির কারণে জারদারির নেতৃত্বাধীন পিপিপি সরকারের আয়ু কতদিন হবে তা নিয়ে শুরু থেকেই সন্দেহ ছিল। তদুপরি বেসামরিক সরকার এমন এক সময় দায়িত্ব হাতে পেল, যখন তাদের ভেতর-বাহির উভয় দিক থেকেই জঙ্গি চাপ, বেসামাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও অস্থিতিশীল সামাজিক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয় এবং এখনও হচ্ছে। তবে জারদারি ভালোই বুঝে ছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রকে বশে রাখতে পারলে এবং তাদের পরামর্শমতো ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করায় পদক্ষেপ নিতে পারলে ওয়াশিংটন তথা পশ্চিমা দুনিয়া পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের ওপর থেকে আস্থা তুলে নেবে না। জারদারি সহজাত বুদ্ধি এখানে মোক্ষম দাওয়াই হিসেবে কাজ করেছে। ওয়াশিংটন বরাবর সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিতে চাপ দিয়েছে এবং এখনও তা অব্যাহত রেখেছে। ওসামাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরাপদ আস্তানার ব্যবস্থা করেছে_ এই অভিযোগের সত্যতা তার নিহত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হওয়ার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর ওয়াশিংটনের চাপ আরও বৃদ্ধি পায়। এ কারণে সেনাবাহিনী ওয়াশিংটনের সুদীর্ঘকাল ধরে বজায় থাকা আস্থা হারায়। আর এর সুযোগ পুরোপুরি পায় জারদারি-গিলানির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার।
জারদারি-গিলানি সরকার পাকিস্তানের পর্বতপ্রমাণ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। সরকারের অর্থনৈতিক পারফরম্যান্সও উল্লেখ করার মতো নয়। তবে তারা দেশের মধ্যে বিরাজমান চরম নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান যে ব্যর্থ রাষ্ট্র হবে না, দেশটি যে এখনও ঘুরে দাঁড়িয়ে আধুনিকতাকে আলিঙ্গন করতে পারে, তেমন আশাবাদী ভাবনা এখন পল্লবিত হচ্ছে। বলা যায়, একটি দেশকে নিশ্চিত ধ্বংসের কিনারা থেকে টেনে তোলার ঐতিহাসিক কাজটি পাকিস্তানের বর্তমান বেসামরিক সরকারই করছে। এ জন্য ইতিহাস একদিন এই সন্ধিক্ষণের সরকারকে পরম আগ্রহে বুকে টেনে নেবে। আসলে জারদারির ওপর মানুষের তেমন ভরসা ছিল না কোনোকালেই। তাই তার কাছ থেকে প্রত্যাশাও তাদের বেশি ছিল না। কিন্তু তিনি জাতিকে সঠিক পথের দিশা দিতে সক্ষম হয়েছেন। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ যে জঙ্গিবাদ নয়, সামরিক শাসন নয়, স্থায়ী গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করছে_ এই সত্যটি তার সরকার মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এক সময় নাকি বেনজির ভুট্টো যাতে বিয়ে করার জন্য পাত্র খুঁজে না পান সে ব্যবস্থা করেছিল পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। অন্তত দুটি বিয়ে এ কারণেই নাকি ভেঙে যায় জিয়াউল হকের জমানায়। আর সে সময় জারদারির পরিচিতি করাচির বড় রংবাজ হিসেবে। তিনি নাকি তখন বেনজিরের পাণিপ্রার্থী হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অবশেষে বেনজির তার গলাতেই মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন। এবার বেসামরিক শাসক হিসেবে সেনার সঙ্গে যুঝে চার বছর পার করে দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন সাহসের সঙ্গে সহজাত বুদ্ধির দৌড়ও তার কম নয়!
subashsaha@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.