দুই দু’গুণে পাঁচ-সৌন্দর্য ও সৌন্দর্যবোধ by আতাউর রহমান

গল্প আছে: ত্রিশোর্ধ্ব বয়সের কন্দর্পকান্তি এক অবিবাহিত যুবককে সদ্য পরিচিত একজন লোক প্রশংসা করে বলেছিল, ‘আপনি তো একজন সুন্দর পুরুষ’। তদুত্তরে তিনি বললেন, ‘আমার বাবাও সুন্দর ছিলেন, আমার দাদাও সুন্দর ছিলেন।’ লোকটি অতঃপর বলল, ‘আপনি মনে হচ্ছে একজন বিদ্বান ব্যক্তিও’।

তখন তিনি বললেন, ‘আমার বাবাও বিদ্বান ছিলেন, আমার দাদাও বিদ্বান ছিলেন।’ এবার লোকটি ‘তাহলে আপনি এখনো ব্যাচেলর কেন’ বলতেই তিনি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, ‘আমার বাবাও ব্যাচেলর ছিলেন, আমার দাদাও ব্যাচেলর ছিলেন।’ অর্থাৎ তিনি নিজেই নিজেকে ও স্বীয় পিতাকে বেজন্মা বানিয়ে দিলেন।
অতএব দেখা যাচ্ছে, শুধু বাহ্যিক সুন্দর হলেই হয় না, ভেতরে বুদ্ধিমত্তাও থাকা চাই। মাকাল ফল দেখতে খুব সুন্দর, কিন্তু কাকও সেটা খায় না। প্রসঙ্গক্রমে আব্রাহাম লিংকনের উপাখ্যানটা মনে পড়ে গেল: একবার এক জনসমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে তাঁর কানে এসেছিল, ভিড়ের মধ্যে কে যেন বলছে, ‘আরে, এঁনার তো দেখছি চেহারাটা একেবারে সাদামাটা। লিংকন পাশ ফিরে লোকটাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘বন্ধু, ঈশ্বর নিশ্চয়ই সাদামাটা চেহারার লোকদের বেশি পছন্দ করেন, যে জন্য অধিকসংখ্যক লোককেই তিনি সাদামাটা চেহারা দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।’
আর সৌন্দর্য ব্যাপারটা বহুলাংশে আপেক্ষিক, যে কারণে ইংরেজি ভাষায় একটি কথাই আছে যে ‘বিউটি লাইজ ইন দ্য আইজ অব দ্য বিহোল্ডার’; অর্থাৎ ‘সৌন্দর্য দৃষ্টিপাতকারীর অক্ষিযুগলে নিহিত।’ মায়ের কাছে সব সন্তানই সুন্দর; সেটা মানুষের বেলায় যেমন, পশুপক্ষীদের বেলায়ও তেমনই। ছোটবেলায় গল্প পড়েছিলাম: বাজপাখি অন্যান্য পাখির বাচ্চা খেয়ে ফেলে। তো পেঁচারা দল বেঁধে গিয়ে কাকুতি-মিনতি করায় বাজপাখি দয়াপরবশ হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমাদের বাচ্চাগুলো আমি খাব না। কিন্তু তোমাদের বাচ্চাদেরকে চিনব কী করে?’ পেঁচারা একযোগে বলে উঠল, ‘আমাদের বাচ্চারাই দেখতে সবচাইতে সুন্দর।’ বাজপাখি কথা দিল যে সুন্দর বাচ্চা দেখলে সে খাবে না, কুৎসিত দেখলে খাবে। এবারে বেশি বেশি করে পেঁচার বাচ্চাদের জীবনাবসান ঘটতে লাগল।
সে যা হোক। যুগে যুগে জগতের তাবৎ জ্ঞানী-গুণীরা সৌন্দর্য সম্পর্কে নানাবিধ জ্ঞানগর্ভ উক্তি করে গেছেন; এ স্থলে আমি মাত্র গুটি কয়েক উদ্ধৃত করতে চাই: চায়নিজ দার্শনিক কনফুসিয়াস বলে গেছেন, ‘সৌন্দর্য প্রত্যেকের মধ্যেই আছে কিন্তু সবাই তা দেখতে পায় না’ এবং টমাস মূলার বলেছেন, ‘আত্মার সৌন্দর্য মানুষকে পরিপূর্ণতা দান করে’। ইংরেজ রোমান্টিক কবি কিটস তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘সত্য হচ্ছে সুন্দর আর সুন্দরই সত্য’; অপর একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘সুন্দর জিনিস চিরকালের আনন্দ।’ আর দার্শনিক সক্রেটিসও বলে গেছেন, ‘সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী’। তা সৌন্দর্য যে ক্ষণস্থায়ী, সেটা ফুলের দিকে তাকালেই বিলক্ষণ উপলব্ধি করা যায়। এবং এটাও যথার্থ যে, শারীরিক সৌন্দর্য হচ্ছে অনেকটাই ‘স্কিল-ডিপ’সর্বস্ব।
ইংরেজি ভাষায় রচিত হাস্যরসের বইয়ে অবশ্য সৌন্দর্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, সৌন্দর্য হচ্ছে সেই শক্তি, যা দ্বারা একজন নারী তাঁর প্রেমিককে মুগ্ধ ও স্বামীকে আতঙ্কগ্রস্ত করতে পারেন। সংজ্ঞাটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত যাযাবরের সাড়া জাগানো রম্যগ্রন্থ দৃষ্টিপাত-এর একটি উক্তি: ‘আধুনিকাদের হস্তে শোভা পায় ভ্যানিটি ব্যাগ; সেটার গর্ভে নিহিত প্রসাধনসামগ্রী নিজের স্বামীর হূদয়ে ত্রাস ও অন্যের স্বামীর হূদয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।’ তবে আধুনিক নারী ও পুরুষদের সৌন্দর্য যে বহুলাংশে কসমেটিকস কোম্পানিগুলোর দান, সেটা কে না জানে।
ফার্সি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে: ‘মনোরম মুখগুলোকে দেখতে হয় জোছনা রাতে, যখন একজন সেটা দেখে অর্ধেক নয়ন দিয়ে ও অর্ধেক কল্পনা দিয়ে।’ আশ্চর্যের কিছুই নয় যে, কবিগুরু গান লিখেছেন, ‘আজি জোছনা রাতে সবাই গেছে বলে’; আর আমাদের একালের প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ সাহেব জোছনা রাতকে এতটা ভালোবাসেন, তাঁর লেখায় ঘুরেফিরেই জোছনার কথা আসে।
বাংলা ভাষায় পুরুষদের বেলায় আমরা ব্যবহার করি ‘সুন্দর’ আর নারীদের বেলায় ‘সুন্দরী’। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় শব্দভান্ডার বোধ করি অধিকতর সমৃদ্ধ; তাই ইংরেজিতে মেয়েদের বেলায় ব্যবহার করা হয় ‘বিউটিফুল’ আর পুরুষদের বেলায় ‘হ্যান্ডসাম’। তো ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে: ‘হ্যান্ডসাম ইজ এজ দ্য হ্যান্ডসাম ডার্জ; অর্থাৎ পুরুষ মানুষ শুধু দেখতে হ্যান্ডসাম হলেই চলবে না, কাজেকর্মেও হ্যান্ডসাম হতে হবে বৈকি। কথাটা আমি নিবেদন করলাম তরুণ-তরুণী পাঠকবর্গের উদ্দেশে।
মহামতি বেকন বলেছেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও শোভন হচ্ছে সত্য বলার স্বাধীনতা।’ এটা পাঠোত্তর উদ্দীপ্ত হয়ে এতদ্পরবর্তী কথাগুলো লিখছি: প্রতিদিন সকালে ধানমন্ডি লেকপাড়ে যখন হাঁটতে যাই, তখন ৮ নং রোডের ব্রিজের কাছে গেলেই মনে মনে আমাদের পুলিশ বাহিনীর মুণ্ডপাত না করে পারি না। পাশ্চাত্য ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও ডাইভারশনের জন্য প্লাস্টিকের কৌনস ব্যবহার করা হয়। ওই জায়গার (এবং নগরের অন্যত্রও) বাস্তবতার নিরিখে তাঁরা কংক্রিটের চতুর্ভুজ ব্যবহার করেছেন, ভালো কথা। কিন্তু সেগুলোকে বাঁশ দ্বারা কড়া লাগিয়ে সৌন্দর্যবোধ জিনিসটাকে বাঁশ দিয়ে দিয়েছেন। ইচ্ছে করলে অনায়াসেই বাঁশের জায়গায় সিনথেটিকের রঙিন মোটা রশি ব্যবহার করা যেত; কিন্তু সেই সৌন্দর্যবোধটা থাকতে হবে তো। এ ছাড়া কাঁটাতার দিয়ে মোড়ানো পালকির মতো চেহারার পুলিশের রোড-ব্লকগুলো ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি করা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলো, জামায়াতের নেতারা মন্ত্রী হলেন আবার অন্তরীণও হলেন, পুলিশের উর্দি পরিবর্তিত হলো; কিন্তু এগুলোর ডিজাইনের কোনো পরিবর্তন সাধিত হলো না। অন্তত গায়ে কিছু রং মাখিয়েও খানিকটা সৌন্দর্যবর্ধন করা যেত।
শেষ করছি ফার্সি সাহিত্য-ডাক্তার থেকে আহরিত একটি মনোরম প্রাসঙ্গিক গল্প দিয়ে: একজন অসুন্দর পুরুষের বিয়ে হয়েছে এক পরমা সুন্দরী নারীর সঙ্গে। তো কিছুদিন পর তার বউ একদিন তাকে বলল, ‘আশা করি আমরা দুজনেই মৃত্যুর পর বেহেশতে যাব।’ কী করে বুঝলে? ‘স্বামী প্রশ্ন করল। বউ তখন তাকে বুঝিয়ে বলল, ‘তুমি যখন আমার দিকে তাকাও, তখন নিশ্চয়ই মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো তোমাকে এত সুন্দর বউ দেওয়ার জন্য। এ জন্য তুমি বেহেশতে যাবে। আর আমি যে তোমাকে তালাক দিয়ে চলে যাইনি, ছবর করে আছি; এ জন্য আমিও বেহেশতে যাব।’
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.