শিক্ষাব্যবস্থা-রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা ও আমাদের সংকট by মোহীত উল আলম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাথমিক স্কুলের পাঠ শেষ করেননি। কাজী নজরুল ইসলাম নিম্নমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সম্ভবত দারিদ্র্যের কারণে আর লেখাপড়া করতে পারেননি। তবে তাঁর শৈশবেই জাগ্রত কবিস্বভাবও তাঁকে, রবীন্দ্রনাথ কথিত, স্কুল নামের যন্ত্রটির প্রতি বিকর্ষিত করে তোলে।

আমাদের এ দুই প্রধান কবির যখন এ অবস্থা, তখন ইংরেজ-প্রধান কবি ও নাট্যকার শেক্সপিয়ারের খবর নেওয়া যাক। তিনিও কিছুটা দারিদ্র্য এবং কিছুটা স্বভাববশত প্রাথমিক স্কুল শেষ করে আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়েননি। শেক্সপিয়ারের জীবনীকারেরা তাঁর অ্যাজ ইউ লাইক ইট নাটকের জেকস নামের চরিত্রটির একটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন, তিনি (শেক্সপিয়ার) স্কুলকে রবীন্দ্রনাথের মতোই যন্ত্র মনে করতেন। জেকস বলছে, মানবজীবনের সাতটি পর্যায় আছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে স্কুলে যাওয়ার পর্যায়। কিন্তু জেকস কথিত বালকটি স্কুলে যাচ্ছে নিতান্ত শম্বুক পায়ে, অনিচ্ছাসহকারে, ‘দ্য ওয়াইনিং স্কুলবয়...ক্রিপিং লাইক স্নেইল / আনউইলিংলি টু স্কুল।’
এই তিনজনের স্কুল বিরাগের কথা শুনে মনে হবে, প্রতিভাবানমাত্রই যেন স্কুলবিমুখ হন। কথাটা হয়তো এ রকমও হতে পারে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগের ইংল্যান্ডে এবং বঙ্গদেশের ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষালাভ করা সবার জন্য অবশ্যপালনীয় ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়ায়নি। এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স তাঁর ডেভিড কপারফিল্ড, অলিভার টুইস্টসহ বেশ কিছু উপন্যাসে ইংল্যান্ডের স্কুলগুলোর যে চিত্র এঁকেছেন, তাতে মনে হয় শিক্ষকেরা ছাত্র পেটানো ছাড়া আর কিছু করতেন না। রবীন্দ্রনাথও গৃহে ও স্কুলে কানমলা খাওয়ার কথা তাঁর আর্জেন্টাইন বন্ধু এবং গান্ধীর ভক্ত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কাছে বয়ান করেছিলেন (সূত্র: ‘টেগোর অন দ্য ব্যাঙ্কস অব দ্য রিভার প্লেইট’)। কিন্তু আজ এ তিনজন পুরুষই নিজ নিজ দেশের সমাজে শিক্ষাব্যবস্থার সর্বব্যাপী অস্তিত্বের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ না করে পারতেন না।
আমার এ আলোচনাটা উঠে আসছে সম্প্রতি প্রথম আলোর আয়োজনে পালিত ‘রবীন্দ্রনাথ এ সময়ে’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী সেমিনারের শেষ অধিবেশনটির প্রেক্ষাপটে। ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা’বিষয়ক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সভাপতিত্বে ওই আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধটি ছিল আবুল মোমেনের। তিনি অসুস্থতার কারণে সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তাঁর প্রবন্ধটি পঠিত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল, ‘মানবের বিকাশ ও রবীন্দ্র-শিক্ষাদর্শ’; আর আলোচক ছিলাম আমি, দ্বিজেন শর্মা ও গোলাম মুস্তাফা।
বর্তমান আলোচনায় আমি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার সঙ্গে আমাদের দার্শনিক ও প্রায়োগিক শিক্ষাচিন্তার মধ্যে যে একটি দ্বান্দ্বিক কিন্তু সাযুজ্যপূর্ণ সম্পর্ক দেখতে পাই, সে কথা বলার চেষ্টা করব।
ওই আলোচনা সভায় একটি কথা যেন মন্দ্রিত হয়ে উঠেছিল, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চেতনায় অহরহ যে মানবমনের সর্বব্যাপী, আকাশ থেকে ধুলো পর্যন্ত (‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়/ আমার মুক্তি ধূলায় ধূলায়’) মুক্তির কথা বলা হয়েছে, তাই যেন বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষানীতির মূল প্রণোদনা হওয়া উচিত। এ কথার সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। রবীন্দ্রনাথ প্রথাগত অর্থে কোনো শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু প্রথাগতভাবে আমরা যারা শিক্ষকতা করছি, আমরাও মনে করি, মানবমনের মুক্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে যেকোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য। বস্তুত, আমি মনে করি না, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাবিষয়ক মৌলিক ভাবনার সঙ্গে আমাদের শিক্ষাবিষয়ক চিন্তার পার্থক্য আছে। এমনকি মোমেন যে নূরুল ইসলাম নাহিদের উক্তি ‘যে শিক্ষা, জ্ঞান ও দক্ষতা বাস্তব জীবনে লাগে না বা বাস্তবে প্রয়োগ করা যায় না—তা অর্থহীন’কে সমালোচনাবিদ্ধ করেছেন, সেটিও আসলে রবীন্দ্র-শিক্ষাদর্শের বাইরের কথা নয়। কারণ, রথীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথামূলক ইংরেজি রচনা ফাদার অ্যাজ আই নু হিম-এ বলছেন, শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ নিজে ছেলেমেয়েদের ইংরেজি-বাংলা পড়াতেন এবং অঙ্ক, বিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদি পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন, যাঁদের আগে তিনিই সবক দিয়ে নিতেন কীভাবে পড়াতে হবে। অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথও শিক্ষা গ্রহণকে একটি সুশৃঙ্খল চর্চা মনে করতেন, যেটার পাঠ গ্রহণের সঙ্গে বাস্তব জীবনের বেড়ে ওঠার সম্পর্ক থাকবে এবং সেটারই চিরকালীন সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভৌত রূপ হচ্ছে বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু এ বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল পশ্চাৎপদ সমাজে কীভাবে কাজ করবে, সে শৃঙ্খলাটা তৈরি করা হচ্ছে মূল সংকট। অর্থাৎ, সংকটটা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের মানবমনের মুক্তির উদ্দেশ্যে পরিচিন্তিত শিক্ষানীতির সঙ্গে বাংলাদেশের বিরাজমান শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় সাধন করা। কাজটা আমাদের জন্য তো কঠিন, রবীন্দ্রনাথের জন্যও যে কেমন কঠিন হয়ে পড়েছিল, তার একটি আন্দাজ পেলাম দেশ-এর ‘রবীন্দ্রনাথ: সার্ধশতবর্ষ’ সংখ্যায় অরুণ নাগের ‘অপরিকল্পিত পরিকল্পনা: শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী’ প্রবন্ধটি পড়ে। কিছুদিন আগে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত এবং অধ্যাপক ফকরুল আলম ও রাধা চক্রবর্তী সম্পাদিত দ্য এসেনশিয়াল শেক্সপিয়ার গ্রন্থটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন বিশ্বভারতীর ইংরেজির অধ্যাপক সোমদত্তা মণ্ডল। তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে এক আলাপচারিতায় জানিয়েছিলেন, বিশ্বভারতীর পড়াশোনার মান খুব খারাপ পর্যায়ে আছে। কারণ, শান্তিনিকেতনের আশপাশের কলেজগুলো থেকে এত নিম্নমানের শিক্ষার্থী ভর্তি হয় যে শিক্ষার মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। অরুণ নাগের প্রবন্ধও একই কথা স্বীকার করছে। তবে তাঁর ক্ষোভটা পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত সরকারের ওপর, কেননা ১৯৫১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিভুক্ত হওয়ার পরও কেন কবিগুরুর স্বপ্নানুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়টা রূপ পাচ্ছে না, সেটা হচ্ছে তাঁর অভিযোগ।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথকেও জীবিতকালে তাঁর স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বারবার রফাদফার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এক ছিল অর্থায়নের সংকট, আরেক ছিল সনদ স্বীকৃত করার সংকট। ১৯০১ সালে মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মাচার্যশ্রম বিদ্যালয়ের সূচনা হয়। পাঁচজন ছাত্রের মধ্যে দুজন ছিল রবীন্দ্রনাথের দুই ছেলে যথাক্রমে রথীন্দ্রনাথ ও শমীন্দ্রনাথ। কিন্তু প্রশ্ন উঠল, যে স্কুল থেকে ডিগ্রি মিলবে না, সে স্কুলে ছাত্র ভর্তি হবে কেন! তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে প্রাইভেট ব্যবস্থায় ম্যাট্রিকুলেশন ডিগ্রি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। পরে ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা পেলে তখনো ডিগ্রি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন ওঠে বিশ্বভারতী থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সনদের গুরুত্ব নিয়েও। কারণ চাকরির বাজারে বিশ্বভারতীর ডিগ্রির কদর ছিল কম। তখন আবারও বিশ্বভারতী কর্তৃক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রচিত আইএ, বিএ এবং আইএসসি পাঠ্যসূচি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত হয়, এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই পরীক্ষা পরিচালিত হওয়া ও ডিগ্রি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় (১৯২৫)। এ ব্যবস্থা চলে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত যখন কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্বভারতীকে অধিগ্রহণ করে।
ওপরের তথ্যগুলো এ জন্য দিলাম যে যেকোনো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে একটি পেশাগত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতেই হবে। মানুষের মনকে মুক্ত করতে হবে—এটি একটি দর্শন, কিন্তু এটির সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবায়নে ঢুকে পড়ছে অগুনতি মানুষ, যাদের সঠিক কোনো স্বপ্ন নিয়ে মাথাব্যথা নেই, যাদের দরকার শিক্ষা শেষে জীবিকা। তখন না চাইলেও স্বপ্নের ইতরায়ন শুরু হয়, চলতে থাকে এর কদর্য কিন্তু সর্বজন অনুমোদিত ব্যবহার। সমস্যাটি আমরা আলফ্রেড নোবেলের ডিনামাইট আবিষ্কার বা বিল গেটসের মাইক্রোসফট উদ্ভাবনের মৌলিক উদ্দেশ্য এবং তাঁদের (ডিনামাইট এবং মাইক্রোচিপসের) সর্বজন ব্যবহারের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। ডিনামাইট দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো যায়, মাইক্রোচিপস দিয়ে সন্ত্রাসী বার্তা ছড়ানো যায়। এগুলো হলো একটি মহৎ স্বপ্নের ইতরায়ন। রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন নিয়েও একই কথা। বিশ্বভারতীকে সাধারণভাবে ডিগ্রি প্রদানের মতো আর দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হতে হলো।
পূর্বে উল্লিখিত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর অত্যন্ত সংবেদনশীল রচনাটিতে শিক্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের খেদোক্তি সম্পর্কে ওকাম্পো মন্তব্য করেছেন, মহৎ লোকদের স্বপ্ন যখন নিচের দিকের লোকের হাতে পড়ে, তখন তা অবক্ষয়িত হতে থাকে এবং তা-ই হয়েছে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনকেন্দ্রিক স্বপ্নের।
আমার কথা হলো, রবীন্দ্রনাথকে যে তাঁর জীবদ্দশায় বিশ্বভারতীর অবক্ষয় দেখে যেতে হয়েছে, সেটা ছিল অবশ্যম্ভাবী। একবার বিশ্বভারতী ঘুরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছেলে রথিকে লিখলেন, তিনি শিক্ষকদের গা-ঢিলে দেওয়া জীবনযাপন দেখে খুব হতাশ হয়েছেন। আমরাও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ দেখে মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারি না।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও যে রবীন্দ্রনাথ-উদ্দিষ্ট মানবমনের মুক্তি, বিজ্ঞানের খোঁজ, সমাজবিচার ও বিশ্লেষণের চর্চাকেন্দ্র হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত ভারতবর্ষে হয়তো নেই, কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকা এবং দূরপ্রাচের কোনো কোনো দেশে যে নেই, তা নয়। রবীন্দ্রনাথও সেটা জেনেছিলেন বলে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আমি তাই বলছি, মানবমনের মুক্তিভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান এ বাংলাদেশেও সম্ভব। প্রশ্নটা কাঠামোগত, অর্থাৎ অত্যন্ত জনবহুল ছাত্রসমাজকে কীভাবে মোটামুটি সন্তোষজনক ভৌত সুবিধাদির মধ্যে ঢোকানো যায়, সেটাই হলো পরীক্ষা বা চ্যালেঞ্জ। ভৌত সুবিধাদির আয়োজন ও আধুনিকায়ন, শিক্ষার উপকরণ সরবরাহ ও তৈরি করা। ছাত্র নির্মাণ, জ্ঞান নির্মাণ ও শিক্ষক নির্মাণ—এগুলো সব হচ্ছে রবীন্দ্রকথিত শিক্ষাদর্শ বাস্তবায়নের রাস্তা। এ রাস্তা তৈরি করতে প্রয়োজন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, জনসংখ্যা মন্ত্রণালয় ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় মিলে একটি কেন্দ্রীয় কাঠামো তৈরি হওয়া, যার ফলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ, শিক্ষক তৈরি, শিক্ষার্থী ভর্তি, পাঠাগার নির্মাণ, আইটি সুযোগ, সড়ক বা নৌযোগাযোগের ব্যবস্থাসহ অর্থায়নও নিশ্চিত থাকে। শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড, এটা ঠিক থাকলে আর সবকিছু ঠিক থাকবে।
ড. মোহীত উল আলম: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.