পেটেন্ট আইন-ওষুধশিল্পের অশনিসংকেত! by আ ব ম ফারুক

গত এক বছরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বেশ কয়েকটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেগুলোতে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ‘ট্রেড রিলেটেড এসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস’ সংক্ষেপে ‘ট্রিপস’ বা মেধাস্বত্ব আইনের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, সে বিষয়ে নীতিনির্ধারণী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বিশেষ করে, ২০১৫ সালের পর মেধাস্বত্ব আইনের ভবিষ্যৎ পর্যায়, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ট্রিপসের আওতায় আনা যাবে কি না, আনা গেলে কীভাবে আনতে হবে, মেধাস্বত্ব নিয়ে কতটুকু কড়াকড়ি করা যাবে—এগুলো নিয়েই অধিবেশনে আলোচনা হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এই মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে বিগত দশক থেকেই উন্নত বিশ্ব যে অবস্থান নিয়েছে, গরিব দেশগুলো ক্রমাগত এর প্রতিবাদ করে আসছে।
মেধাস্বত্ব আইনের বিষয়টি বিভিন্ন কারণে শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বরং স্বল্পোন্নত ৫০টি দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওষুধবিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির বর্তমান পর্যায়ে উন্নত বিশ্ব যেখানে যৌন সমস্যা, টাক ও স্থূলতার মতো কম গুরুত্বপূর্ণ অসুখগুলো নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত, তারা এগুলোর নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কারের জন্য বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতেও পিছপা হয় না, সেখানে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে অসংখ্য সংক্রামক রোগসহ ম্যালেরিয়া, ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা ও এইডসের মতো মারাত্মক প্রাণঘাতী অসুখের হাত থেকে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। গরিব দেশের এসব সংক্রামক রোগের নিরাময়ী ওষুধ আবিষ্কারে উন্নত বিশ্বের ওষুধ কোম্পানির গবেষণাগারগুলো তেমন আগ্রহী নয়। মুনাফা তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার কারণে উন্নত বিশ্বের বৃহৎ পুঁজির কাছে স্বল্পোন্নত দেশের প্রাণঘাতী অসুখ ও ওষুধের সামান্য ছোট বাজার তাই খুব আকর্ষণীয় নয়।
কিন্তু তবু কিছু বিদেশি ওষুধ কোম্পানি স্বল্পোন্নত দেশের ছোট বাজারও হাতছাড়া করতে চায় না। তারা তাই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব আইনের অধীনে নতুন আবিষ্কৃত বিভিন্ন ওষুধের পেটেন্ট নিয়ে স্বল্পোন্নত দেশের বাজারে আসে এবং সেসব ওষুধের দামও হয় অনেক বেশি, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গরিব মানুষের আওতার বাইরে। নতুন ওষুধ আবিষ্কারে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয় অবশ্যই। আমরা অবশ্যই চাইব, যথেষ্ট মুনাফাসহ এই পুঁজি ওষুধটির আবিষ্কারক বিনিয়োগকারী কোম্পানির কাছে ফেরত আসুক। কিন্তু মুশকিল হলো পেটেন্ট আইনের সুযোগ নিয়ে উন্নত বিশ্বের আবিষ্কারক কোম্পানিগুলো তাদের পেটেন্টকৃত ওষুধের দাম নির্ধারণ করে আকাশচুম্বী। ফলে গরিব দেশের মানুষেরা অসুস্থ হলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ওষুধ কিনতে পারে না। অনেকে বাধ্য হয়ে দৈনন্দিন খাদ্যের পুষ্টিমূল্যকে বিসর্জন দেওয়ার বিনিময়ে অনেক বেশি দাম দিয়ে ওষুধ কেনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা উচ্চমূল্যের কারণে ওষুধের প্রয়োজনীয় কোর্সও পুরো করতে পারে না। ফলে তাদের অসুখ পুরোপুরি সারে না। ওষুধটি অ্যান্টিবায়োটিক হলে কোর্স পুরো না করার কারণে জীবাণুগুলো রেজিস্ট্যান্ট বা প্রতিরোধী হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে প্রতিরোধী এ জীবাণুগুলো মারা হয় কষ্টকর।
সম্প্রতি গরিব দেশগুলোতে যে মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট যক্ষ্মার জীবাণুর আবির্ভাব ঘটেছে তা আমাদের জন্য বড় মাপের একটি জনস্বাস্থ্য-সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তা ছাড়া ওষুধের পেটেন্ট আগে দেওয়া হতো সাত বছরের জন্য, পরে কোনো কোনো দেশ তা বাড়িয়ে ১২ বছর করে। এখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস আইনে তা আরও বাড়িয়ে ২০ বছর করা হয়েছে। অর্থাৎ আবিষ্কারক কোম্পানি সুদীর্ঘ ২০ বছর ধরে সারা বিশ্বে নিজের ইচ্ছামতো দামে ওষুধটির একচেটিয়া ব্যবসা করে যাবে। ট্রিপস আইনটি তাই গরিব দেশের জন্য, এমনকি উন্নত দেশের গরিব মানুষদের জন্যও অমানবিক।
এ কারণেই বিগত দশকে মেধাস্বত্ব আইন বাস্তবায়ন শুরুর পর বিশ্বের দেশে দেশে বিজ্ঞানী ও বিবেকবান মানুষ প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। বিগত দশকে উন্নত বিশ্বের যে শহরেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সভা বসেছে সেখানেই সচেতন বিজ্ঞানী ও বিবেকবান মানুষ প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। তাদের সংগঠিত এই প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ২০০১ সালে ‘দোহা ঘোষণা’র মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে মেধাস্বত্ব আইন বাস্তবায়নের কড়াকড়ির ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়। এতে বলা হয়, স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় ওষুধগুলোর পেটেন্ট ২০১৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর হবে না। এর ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলো তাদের দেশে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধগুলোর দাম কম রাখতে সক্ষম হয় এবং এর ফলে সারা বিশ্বে শত কোটি মানুষের জীবন রক্ষা পায়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এখন ২০১৫ সালের পর মেধাস্বত্ব আইনের ভবিষ্যৎ পর্যায় নিয়ে এখন পুনরায় চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বাংলাদেশের জনগণ ও ওষুধবিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে পুনরায় জানাতে চাই যে মেধাস্বত্ব আইন যেন বিজ্ঞানকে অমানবিকভাবে বাণিজ্যিকীকরণের কৌশল, উন্নত বিশ্বের বৃহৎ পুঁজির মুনাফা লোটার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা না হয়। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর শত শত কোটি গরিব মানুষের সুচিকিৎসা পাওয়ার মৌলিক অধিকারের স্বার্থে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে মেধাস্বত্ব আইনের বা আরও সুনির্দিষ্টভাবে ওষুধের পেটেন্ট আইনের আওতার বাইরে রাখার জন্য আমরা আবেদন জানাই। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে ২০১৫ সালের পরিবর্তে অন্তত ২০৩০ সাল পর্যন্ত আমাদের এখানে ছাড় দেওয়া প্রয়োজন। নইলে ২০১৫ সালের পর ওষুধের দাম এত বেড়ে যাবে যে তা বাংলাদেশসহ গরিব দেশগুলোর মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আমাদের দেশে এখন অনেকগুলো ভালো ওষুধ কোম্পানি আছে, যারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত ‘গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি)’ বা উত্তম উৎপাদন-কৌশল অনুসরণ করে উন্নত কারখানায় আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ তৈরি করছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সুখবর যে তারা দেশের অভ্যন্তরীণ ওষুধের বাজারকে প্রায় স্বনির্ভর করতে পেরেছে এবং যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ, ইউরোপের ইইউ, উপসাগরীয় দেশগুলোর জিসিসি, অস্ট্রেলিয়ার টিজিএ ইত্যাদি অনেক সনদ পেয়েছে এবং বর্তমানে ৮৭টি দেশে বেশ কিছু ওষুধ রপ্তানি করছে। আমরা আশা করছি, আমাদের কয়েকটি কোম্পানি অচিরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ সনদ লাভ করবে এবং সেখানে ওষুধ রপ্তানি শুরু করবে। এ ছাড়া আরও আশা করছি যে এসব কোম্পানির অনেকেই এ বছর না হলেও আগামী বছর থেকে চীন ও ভারতের ওষুধ কোম্পানিগুলোর মতো ‘কন্ট্রাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিং’ শুরু করবে অর্থাৎ উন্নত বিশ্বের ওষুধ কারখানাকে এখান থেকে ওষুধ তৈরি করে দেবে। ফলে আমাদের যেমন আয় বাড়বে, তেমনি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর এবং অনেক উন্নত দেশেরও তুলনামূলক গরিব মানুষ সস্তায় ওষুধ পাবে।
কিন্তু আমাদের ওষুধ খাতের এসব অর্জন সবই ব্যর্থ হবে যদি ২০১৫ সালের পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপসের অধীন ওষুধের পেটেন্ট আইন আমাদের ওপর চেপে বসে। আমরা কারও সঙ্গে বৈরিতা চাই না। আমরা শুধু আগামী দিনে একটি শান্তিময় ও যৌক্তিক পৃথিবী প্রত্যাশা করি। আমরা চাই, গরিব দেশগুলোর জনস্বাস্থ্য রক্ষিত হোক। আমরা চাই, গরিব মানুষ সুস্থ থেকে তাদের শিক্ষা ও উন্নয়নের জন্য পরিশ্রম করতে সক্ষম হোক। ৫০টি স্বল্পোন্নত দেশের মোট ওষুধের বাজারটি বিশ্বের মোট ওষুধের বাজারের তুলনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র বলেই বিশ্বের বৃহৎ পুঁজিগুলোর কাছে আমরা দাবি করি, আমাদের কাছ থেকে পেটেন্টের মাধ্যমে মুনাফা না করে আমাদের সব সময়ের জন্য, নিদেনপক্ষে ২০৩০ সাল পর্যন্ত, ট্রিপস থেকে ছাড় দিতে।
আ ব ম ফারুক: ভারপ্রাপ্ত ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
abmfaroque@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.