যুক্তি তর্ক গল্প-গণতন্ত্র-গণতন্ত্র খেলা থেকে উত্তরণ চাই by আবুল মোমেন

সংবিধান সংশোধন সাধারণভাবে একটি ইতিবাচক বিষয়। এতে সরকার ও সমাজের গতিশীলতার প্রমাণ পাওয়া যায়। পৃথিবীর যে দেশেই লিখিত সংবিধান আছে, তাতেই সময় সময় পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তবে বিচার্য বিষয় হচ্ছে, যে কারণে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়, তা জাতির স্বার্থ ও জাতির ভবিষ্যৎ বিবেচনায় কতটা ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী।

বাঙালি সম্পর্কে একটা দুর্নাম হলো, জাতি হিসেবে আমরা বড়ই অধৈর্য, অসহিষ্ণু, আর কেউ একবার একটি ধুয়া তুললে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে অনেকেই তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাতে কাজ হাসিল হলেও প্রায় দেখা যায় তা যথেষ্ট প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাপ্রসূত কাজ হয়নি। কথাটা আরেকটু কঠোর ভাষায় ব্যক্ত করলে বলা যায়, কোনো ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, এ ক্ষেত্রে প্রায়ই সরকার, ক্ষুদ্র দলীয় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যেই এ কাজটা করেছে। সামরিক শাসকেরা তো প্রথমে একদফা সংবিধান স্থগিত করে থাকেন, আর তারপর নিজেদের শাসনকালকে বৈধতার ও দায়মুক্তির ব্যবস্থা করে যান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন সাময়িকভাবে, ধরা যাক তিনটি নির্বাচনের জন্য হতে পারত। এ ব্যবস্থা তো নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্যই চাওয়া হয়েছিল। কেননা, ক্ষমতাসীন সরকারগুলো নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে সাধারণ নির্বাচনকে বরাবর প্রভাবিত করে এসেছে। ‘বিখ্যাত’ মাগুরা নির্বাচনের সূত্রে তৎকালীন বিরোধী দল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং তার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক-তত্ত্ব হাজির করে এবং আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে তা অর্জনও করে।
কিন্তু পরবর্তীকালে দুই বড় দলের আচরণেই বোঝা গেছে, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন তাদের কাম্য নয়, তাদের একমাত্র কাম্য হলো নির্বাচনে বিজয় অর্জন। এ লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, তা নিয়ে দুই দলই বিচার বিভাগের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করেনি, নানা কৌশল ও অপকৌশল খাটিয়ে পছন্দের ব্যক্তিকে প্রধান ও অপছন্দের ব্যক্তিকে ঠেকানোর জন্য উচ্চতর আদালত ও তাঁর বিচারকদের ওপর অন্যায় প্রভাব বিস্তার করে চলেছে—তা কখনো জ্যেষ্ঠতা ডিঙানো, কখনো বিচারকদের বয়স বাড়ানোর মতো ঘটনায় প্রকাশ পায়। ফলে দুই বড় দল কেবল তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থাকে কলুষিত করেনি, এই ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ফায়দা উসুল করতে গিয়ে একই সঙ্গে উচ্চতর আদালতকে ঘিরে অবক্ষয় ও অস্থিরতা তৈরি করেছে।
শুরুতে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিছুতেই মানতে চায়নি, তখন তারা ছিল সরকারে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ কিছুতেই আর তত্ত্বাবধায়ক রাখতে চাইছে না, এখন তারা সরকারে আছে। ছিয়ানব্বই সালে আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক-তত্ত্ব দিয়েছে এবং তা আদায়ে সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়েছে। তখন তারা ছিল বিরোধী দলে। বর্তমানে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যেতে কিছুতেই রাজি নয়, এমনকি সংলাপে বসতেও রাজি নয়, এখন তারা বিরোধী দলে। বড় দুই দলের এই ভোল পাল্টানো ভূমিকাকে নানা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে, কিন্তু সব ছাপিয়ে যে সত্যটা প্রকট হয়ে ধরা দেয় তা হলো, প্রত্যেকেই ক্ষমতাকে লক্ষ্য করেই নিজেদের অবস্থান ও কৌশল ঠিক করছে।
রাজনৈতিক দলের প্রধান একটি কাজ অবশ্যই নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে সরকার গঠন। তার জন্য কিছু কৌশল ও চালাকির আশ্রয় নেওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেটা যদি দলীয় বিবেচনা থেকে সংবিধান সংশোধন কিংবা ক্ষমতার জন্য সংবিধান স্থগিত করার দিকে যায় (যেমনটা সামরিক সরকারগুলো করে থাকে), তাহলে নিশ্চয় তাকে সমর্থন করা যাবে না। কারণ, তাতে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রাষ্ট্র চরম অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়ে যায় বলে উন্নয়ন, অগ্রগতি সবই ব্যাহত হয়।
সম্প্রতি উচ্চতর আদালত সাংবিধানিক বিষয়ে যেসব রায় দিয়েছেন, তাকে সাধারণভাবে স্বাগত জানাতে হয়। সামরিক অভ্যুত্থান, সামরিক শাসন, সংবিধান স্থগিত করা, রাষ্ট্রধর্ম থেকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক পর্যন্ত রায়গুলোকে এক লক্ষ্যাভিমুখী বলা যায়—তা হলো দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। গণতন্ত্র যাতে ব্যাহত না হয় এর জন্য সামরিক অভ্যুত্থান ও সামরিক শাসন ঠেকানোর বিকল্প নেই। এ কথাও জানতে হবে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকেও নীতিগতভাবে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। এর মধ্যে রাজনীতিবিদদের নিজেদের দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ মানুষ হিসেবে আত্মস্বীকারের গ্লানিকর ব্যাপার থেকে যায়। তা ছাড়া এতে বিচারব্যবস্থায় অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে, যা অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। তবে হ্যাঁ, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, প্রয়োজনে উচ্চ আদালতপ্রদত্ত দুই বারের সুযোগ কাজে লাগিয়েই এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
তবে আমরা জানি দুই বড় দলকে আলোচনায় বসানো সহজ কাজ নয়। দুই দল একে অপরের প্রতি বৈরী বলেই বা উল্টো করে বললে, একে অপরের সরকারকে সহযোগিতা করে না বা একে অপরের বিরোধী দলের কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে অনিচ্ছুক বলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেবল নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। গণতন্ত্রের মূল প্রাণকেন্দ্র সংসদ অচল ও প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। এই বৈরী মনোভাব ও সহযোগিতার হাত বাড়ানোর অক্ষমতার ইতিহাসটা কম-বেশি আমাদের জানা আছে।
স্বাধীনতার পরে মুক্তিযুদ্ধ ও আন্দোলনের আদর্শের আলোকে একটি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপযোগী সংবিধান গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ। বায়ান্ন থেকে গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল এবং স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। স্বাধীন দেশের সেই সংবিধানের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যে খুব গণতান্ত্রিকভাবে দেশ চালাতে পারছিল, তা নয়। পরাজিত পাকিস্তানপন্থীদের ষড়যন্ত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশের অতি বিপ্লবী চিন্তা ও তৎপরতার চাপ, অন্যান্য সহযোগী শক্তির উচ্চ প্রত্যাশা, অতি বাম রাজনীতির হঠকারী ভূমিকা এবং নিজ দলের নেতা-কর্মীদের একটি অংশের দুর্নীতি-দখলদারি মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার আশানুরূপ সুশাসন কায়েম করতে পারেনি। এই পটভূমিতে আসে পঁচাত্তরের প্রত্যাঘাত। তাতে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে কখনো প্রকাশ্যে কখনো গোপন তৎপরতায় দেশকে পাক-সৌদি-মার্কিন বলয়ে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। যুদ্ধাপরাধীসহ ধর্মভিত্তিক দল শুধু পুনরুজ্জীবিত করা হলো না, তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে অংশ দেওয়া হলো। বিপরীতে আওয়ামী লীগ, সিপিবিসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে সর্বতোভাবে দমনমূলক ভূমিকায় কাজে লাগানো হলো। বিএনপির এই ভূমিকা আজ পর্যন্ত পরিবর্তন হয়নি। সাম্প্রতিককালে বাংলা ভাই, হুজিসহ বিভিন্ন জঙ্গি তৎপরতার পেছনে তাদের মদদ দেওয়ার বিষয়টি আর গোপন নেই। কিন্তু বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আদর্শে দায়বদ্ধ মানুষ এখনো কম নেই। তা ছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও পরিবার মিলিয়েও জনসংখ্যার একটি বড় অংশের মানসে মুক্তিযুদ্ধ এক গভীর ভাবাবেগের বিষয়। এদিকে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম তাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়ের গৌরবের ভাগ নিতে আগ্রহী। ফলে মুক্তিযোদ্ধা-প্রজন্ম কালের নিয়মে বিদায় নিলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আবেগবাহী প্রজন্মের অভাব হবে না দেশে।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ না চাইলেও দেশে বিএনপিপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি আদর্শিক লড়াই বজায় থাকবে। তার রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক চড়াই-উতরাই সত্ত্বেও এবং নানান আপস-সমঝোতার পরও আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল হিসেবে টিকে থাকে। কারণ, মাঠপর্যায়ে ইস্যুটি এখনো জীবন্ত এবং এ ইস্যু থেকে রাজনৈতিক ফায়দা একমাত্র তারাই তুলতে পারবে।
ক্ষমতার দিকে লক্ষ রেখে এবং মোল্লাদের মধ্যে সমর্থনের ভিত্তি বাড়ানোর অভিপ্রায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাহাত্তরের সংবিধানের পরিপন্থী কাজ করা এবং এমনকি সুপ্রিম কোর্টের রায় থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রধর্ম ও বিসমিল্লাহর ব্যাপারে আওয়ামী লীগ আপস করছে। এ ক্ষেত্রে তাদের বিবেচনা হলো আপসে ক্ষমতা ধরে রাখতে সুবিধা হবে, এটুকু সুবিধাবাদের আশ্রয় নিলে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থানকেই এখনকার জন্য ক্ষমতার অনুকূল বলে মনে করছে তারা।
এটা অবশ্যই একটা রাজনৈতিক বিবেচনা ও সংগ্রামের কৌশল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একদিকে জাতির রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং অন্যদিকে সংবিধান ও গণতন্ত্র সুরক্ষার যে দায়িত্ব, তার কী হবে? কেবল এ দল আর ও দলের মিউজিক্যাল চেয়ার তো শেষ পর্যন্ত একটা খেলা। রাজনীতিকে এভাবে খেলা বানিয়ে ছাড়লে গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ, ডিজিটাল বাংলাদেশ খেলো হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগকে দ্বিমুখী তরবারির মতোই কার্যকর হতে হবে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের আদর্শিক লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, অন্যদিকে সংবিধান সমুন্নত রেখে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সংহত করতে হবে।
কিন্তু কেবল ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার চালাকির খেলায় মত্ত থাকলে নিজেরই অজান্তে আদর্শের জায়গায় বড় বড় আপস করতে হবে, এখন যেমন রাষ্ট্রধর্ম, বিসমিল্লাহ ইত্যাদিতে হচ্ছে। আরও অনেক দিকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিএনপি ও সমমনাদের কাছাকাছি চলে আসছে। মুখে যতই আস্ফাালন করা হোক অনেক ক্ষেত্রে কার্যত জামায়াতেরও কাছাকাছি থাকছে আওয়ামী রাজনীতি, দূরত্ব হচ্ছে প্রগতিশীল আধুনিক গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের সঙ্গে। ষাটের দশকের সঙ্গে কত তফাত ঘটে গেছে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে! পিতা ও কন্যার রাজনীতির এই পার্থক্য যুগের দাবিতে ঘটেনি, ক্ষমতার প্রয়োজনে ঘটেছে। এটাই আফসোসের কথা।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.