সরল গরল-রাষ্ট্রধর্ম কি আওয়ামী লীগের তুরুপের তাস? by মিজানুর রহমান খান

খবরটি ছাপা হয়েছিল ১৯৮৮ সালের ১৪ মে কুয়েত টাইমস-এ। বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদ খবরটি প্রথম পাতায় বক্স আইটেম হিসেবে খুবই যত্নের সঙ্গে ছেপেছিল ৭ জুন ১৯৮৮। শ্রদ্ধেয় বজলুর রহমান (কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর প্রয়াত স্বামী) তখন সংবাদ-এর সম্পাদক।

১৪ মের একটি বাসি খবর বাংলাদেশের পত্রিকায় এমন ঘটা করে পুনর্মুদ্রিত হওয়ার নিশ্চয় গুরুত্ব ছিল। আর সেই কারণটি ছিল রাষ্ট্রধর্ম।
বক্স আইটেম হিসেবে ছাপা সংবাদ-এর উল্লিখিত খবরটি এ রকম: শিরোনাম ‘কুয়েতি পত্রিকার মন্তব্য: এরশাদ তুরুপের তাস খেলছেন’। রিপোর্টে বলা হয়, ব্রিজ খেলোয়াড়দের জন্য একটি সাধারণ নিয়ম হলো, যখনই অসুবিধায় পড়বেন, তুরুপের তাসটি খেলবেন। কিন্তু রাজনীতিকেরা যখন তুরুপের তাস খেলবেন, তখন ধরে নিতে হবে যে খেলার ব্যাপারে তাঁরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা যে ঝামেলায় আছেন, এটা তারই স্বীকারোক্তি। পত্রিকাটি জেনারেল এরশাদকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল যে এ ধরনের তুরুপের তাস সুদানের জেনারেল নিমেরি খেলেছিলেন। কিন্তু তাঁর শেষরক্ষা হয়নি।
’৮৮তে কী পরিস্থিতিতে এবং রাষ্ট্রধর্ম বিল পাসের পর পরিবেশ কেমন ছিল তা আমরা স্মরণ করতে পারি। এর উদ্দেশ্য কাউকে খাটো বা আহত করা নয়। আমরা কোথায় ছিলাম, কোথায় গিয়েছি, কোথায় যাচ্ছি, কোথায় যাব—সেসব প্রশ্নের মীমাংসা না হোক, কিন্তু আলোচনা করতে, আয়নায় নিজেদের মুখ দেখে নিতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়।
আসুন, ১৯৮৮ সালের মে-জুন মাসের পত্রিকার পাতা ওল্টাই।
১০ জুন ১৯৮৮, ইত্তেফাক-এর প্রথম পাতায় প্রকাশিত খবর: ‘গতকাল আটদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অষ্টম সংশোধনী বিল এ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্যই আসিয়াছে। ভবিষ্যতে সুযোগ পাইলে আমরা এই বিল বাতিল করিয়া দিব।’ ১৯৮৮ সালের পর এবারই প্রথম তিনি সুযোগ পেয়েছেন। এখন তিনি মন্ত্রী এ কে খোন্দকারকে বলছেন, তখন পারেননি, এখন বলছেন কেন? এই স্ববিরোধিতা হরতাল ও তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
শেখ হাসিনা রাষ্ট্রধর্ম বিল পাসের সহায়তাকারীদের ‘জাতীয় শত্রু’ আখ্যা দিয়ে তাদের প্রতিহত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে লইয়া যাহারা গদি রক্ষা করিতে চাহে, ধর্মকে যাহারা যথেচ্ছ ব্যবহার করিতে চাহে, তাহাদের বিরুদ্ধেই আমাদের সংগ্রাম।’ তাঁর সেদিনের মন্তব্য বাসি হয়নি। এই সংগ্রাম চলেছে, চলছে ও চলবে।
ইদানীং আওয়ামী লীগের যাকেই জিজ্ঞেস করবেন, ত্বরিত উত্তর পাবেন, বেগম খালেদা জিয়ার হাতে তাঁরা ইস্যু তুলে দিতে চান না। কিন্তু সেদিন ‘ধর্মের অপব্যবহারকারী’ ও ‘ধর্ম ব্যবসায়ী’ বিএনপি-জামায়াতের কী ভূমিকা ছিল?
আমরা যেটুকু দেখেছি, তাতে রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে প্রকাশ্যে সাইনবোর্ড মার্কা কিছু দলেরই সমর্থন ছিল। আইভি রহমানের (রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের প্রয়াত স্ত্রী) সভাপতিত্বে মহিলা সমিতির জরুরি সভায় রাষ্ট্রধর্ম বিল পাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট বার ছিল আরও সোচ্চার।
এর বিপরীতে সামনে এসেছিল দুটি ‘বড় মাপের’ চরিত্র। দুজন পীর। একজন আটরশির। বিতর্কিত। অন্যজন শর্ষিনার। রাজাকার হিসেবে নিন্দিত। ৭ জুন সংসদে বিল পাস হয়। আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলও সংসদে সমর্থন দেয়নি। পরের দিন ৮ জুন এরশাদ পীরের কদমবুসি নিতে আটরশিতে যান। বলেন, রাষ্ট্রধর্ম বিল পাসে আটরশির পীরই তাঁর অনুপ্রেরণা। শর্ষিনার পীর ঢাকায় এসে এরশাদের বাসভবনে গিয়ে ‘জাতির পক্ষ থেকে’ খালেস শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন।
মওদুদ আহমদ জানিয়েছিলেন, কোনো এক জেনারেলের বউ-তালাকের ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট ছয় টুকরো হয়েছিল। বিতর্কিত অষ্টম সংশোধনীর দুই কীর্তি। সুপ্রিম কোর্ট খণ্ডকরণ ও রাষ্ট্রের ধর্মকরণ। রাষ্ট্রের খতনাকরণের সুযোগ অবশ্য এরশাদ পাননি।
তবে দেখার বিষয় হলো, একটির নেপথ্যে এক জেনারেলের বউ, আরেকটির নেপথ্যে আটরশির পীরের স্বপ্ন। এরশাদের স্বপ্নের দোষ সুবিদিত।
রাষ্ট্রের ধর্মকরণের প্রতিবাদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোটই শুধু হরতাল করেছিল—তাহলে সান্ত্বনা একটু হলেও বেশি পেতাম। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোটও পিছিয়ে থাকেনি। ১২ জুন ১৯৮৮ সারা দেশে ভোর ছয়টা থেকে দুটো পর্যন্ত হরতাল হয়েছিল। সেই হরতাল কি ভয়তাল ছিল? সেই হরতাল পালন কি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না?
এমনও নয় যে, বিএনপির তখনকার চৌকস মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমান রাষ্ট্রধর্ম বিল পাসের রাজনৈতিক বদমতলব সম্পর্কে জনগণের সামনে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁর অসাধারণ শাণিত যুক্তি ছিল। হরতালের আগের দিন ১১ জুন বিকেলে গুলিস্তান টেলিফোন ভবন স্কোয়ারে ড. মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম প্রমুখকে আমরা দেখেছিলাম। বিএনপির মহাসচিবের একটি প্রাজ্ঞ উক্তি প্রণিধানযোগ্য, ‘ইসলাম কোনো শিল্প বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নয় যে একে রাষ্ট্রীয়করণ করতে হবে।’
জেনারেল জিয়া ও তাঁর মন্ত্রণাদাতারা ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বুঝতে পারেননি, তা তো নয়। মওদুদ সেখানে ছিলেন। মওদুদ সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ’৮৮ সালে সংসদে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে তাত্ত্বিক ভিত্তি দেন। তবে মওদুদ ও অন্যরা যেটা চেপে যান, সেটা হলো ‘নিয়ত’। যুক্তরাষ্ট্রের টাকার নোটে গড কিংবা নরওয়েসহ অনেক দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের মতো বিধানগুলো স্বৈরশাসকের বৈধতা কিংবা কারও ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার খারাপ নিয়ত থেকে করা হয়নি।
খালেদা জিয়ার বিবৃতি ছিল এ রকম, ‘স্বৈরাচারী সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করার নামে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে ও বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে।’
জনগণের নামে রাজনীতিকেরাই মিথ তৈরি করেন। আবার তাঁরাই তা ভাঙেন। ২৩ বছরের ব্যবধানে রাষ্ট্রধর্ম তাস কীভাবে খেলানো হচ্ছে! বর্তমান নির্বাচিত সরকার কি রাষ্ট্রীয় ধর্ম বহাল রেখে জাতিকে বিভ্রান্ত ও বিভেদ সৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ দিচ্ছে? বিপুলসংখ্যক রেডি মোসাহেব ও জ্ঞানপাপীদের দিকে তাকান। এরা সর্বদা সরকারি অবস্থান সমর্থন করে যাচ্ছে। অবশ্য সরকার বদলালে তাদের কী করার আছে!
আওয়ামী লীগ কি জামায়াতকে লজ্জা দিচ্ছে? তাদের মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম সাক্ষ্য দিচ্ছে, রাষ্ট্রধর্মের ঘটনাকে তারা স্বাগত জানায়নি। সাতদলীয় জোটের শরিক হিসেবেও হরতাল পালনে তারা বিমুখ ছিল না। ৯ জুন সংগ্রাম-এর প্রথম পাতায় মোটা হরফে শিরোনাম ‘গদি রক্ষার স্বার্থেই অষ্টম সংশোধনী আনা হয়েছে—আব্বাস আলী খান’।
বিএনপি ও জামায়াতের সেদিনের অবস্থান শঠতাপূর্ণ ধরে নিলে কেন আমাদের এখন বিএনপি-জামায়াত জুজুর ভয় দেখানো হচ্ছে? ধর্মের প্রশ্নে কেন আমাদের প্রতিটি বড় দলের বর্তমান অবস্থান শঠতাপূর্ণ ধরে নেওয়া হবে না?
ছাত্রশক্তি আজ কোথায়? ৯ জুন ১৯৮৮, ১৬ ছাত্রসংগঠনের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছিল। ৭ জুন বিল পাসের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল বেরিয়েছিল। সংগ্রাম বলেছে, রাজধানীতে ১১টি গাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সংবাদ-এর প্রথম পাতায় আগুনে পুড়তে থাকা একটি গাড়ির ছবি ছাপা হয়েছিল। সংবাদ লিখেছে, রাত পৌনে ১১টার দিকে পলাশীর মোড়ে নারকেলতেলবাহী একটি ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আচ্ছা, ২৩ বছর পর একই কারণে যে একটি গাড়িও হয়তো পুড়বে না, এর প্রকৃত কারণ কী? তথাকথিত জাতীয় মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত বলেই কি?
হাইকোর্টে রাষ্ট্রধর্ম চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রিটের শুনানি চলছে। অ্যাটর্নি জেনারেল ফাঁপরে আছেন। তত্ত্বাবধায়ক ও সামরিক শাসনকে অবৈধ বলাতে যাঁরা আদালতে ভক্তি রেখেছেন, তাঁরা এখন পিছুটান দিয়েছেন। প্রথম দুটি শেখ হাসিনা চেয়েছেন। তৃতীয়টি তিনি চান না। রিট আবেদনকারীরা আপাতত নিষ্ক্রিয় হলেই উত্তম। পুনর্মুদ্রিত বা পাস হতে চলা সংবিধানমতেই রাষ্ট্রধর্ম সাংঘর্ষিক, তবে এমন রায় পাওয়ার সময়টা অনুকূল নয়।
আমাদের প্রথম প্রধান ডাকহরকরা (মুক্তিযুদ্ধকালের পিএমজি) ব্যারিস্টার মওদুদ কিন্তু প্রথমে ঠিক বার্তাই রটিয়েছিলেন। ১৯৮৮-তে প্রধানমন্ত্রী পদে চাকরিরত অবস্থায় তাঁর দেওয়া রাষ্ট্রধর্ম-বিবৃতি আর তাঁর হাইডেলবার্গ ও হার্ভার্ডে প্রস্তুত (১৯৮০-৮১) পাণ্ডুলিপির তফাত দিন-রাতের। মওদুদ লিখেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও কোনো ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র কর্তৃক রাজনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান না করার মূলনীতি বাংলাদেশ সংবিধানের ‘একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও দৃঢ় পদক্ষেপ এবং তা সমধিক প্রগতিশীল এবং আদর্শমণ্ডিত’।
আমরা এখন কোন নেতা-নেত্রী বা কোন দলের কোন ব্যক্তির কখনকার কোন অবস্থানকে ‘জাতীয় প্রয়োজন’ বা ‘জাতীয় চিন্তাগত সততার’ আলোকে দেখব, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। পাঁচ দলের নেতা মেনন বলেছিলেন, ‘সামরিক শাসনের পরই ইসলাম জিন্দা হয়। আইয়ুব, ইয়াহিয়াও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ইসলামের দোহাই দিতেন।’ মহাজোট মিত্র মেনন এখন নিশ্চয় তাঁর মন্তব্যের সংশোধনী আনতে পারেন।
আমরা কি ধরে নেব যে, রাষ্ট্রধর্মের প্রশ্নে ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে? নাকি এটা ইতিহাসে আরেকটি জাতীয় ঠগবাজি, কিংবা জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক পলায়নপর্ব হিসেবে চিহ্নিত হবে?
কুয়েত টাইমস পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা কোনো রাজপুরুষ কিংবা ‘তেল শেখ’ ছিলেন না। কুয়েতি হয়েও সৌদি কূটনৈতিক প্রতিনিধি ছিলেন ফ্রান্সে। অর্থনীতিতে ডিগ্রি নেন লন্ডনে। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের প্রথম ইংরেজি দৈনিক হিসেবে এটি আজও প্রভাবশালী। পত্রিকাটি সংগত কারণেই সুদানি জেনারেল জাফর নিমেরির মধ্যে এরশাদকে খুঁজে পায়। নিমেরির গল্পে লেখাটি শেষ করি। মিসরের সেক্যুলার সাদতের দোস্ত ছিলেন নিমেরি। ১৯৬৯-এ ক্যু করে প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর জিয়ার মতো বহু ক্যু সামলে, গণভোট দিয়ে টিকে ছিলেন। কিন্তু গদি খুব টলছিল। ১৯৮১-তে তিনি মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে নাটকীয়ভাবে সখ্য গড়েন। ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ইসলাম তাঁকে জিন্দা রাখেনি। পরের তিন বছরের কম সময়ের মধ্যে নিমেরি ক্যুতে ক্ষমতাচ্যুত হন। বৃহৎ শক্তি আমেরিকা তাঁকে বাঁচাতে পারেনি। অভ্যুত্থানকালে তিনি ওই দেশটির মেহমানখানাতেই ছিলেন।
আশু প্রশ্ন একটাই, আওয়ামী লীগ কি তুরুপের তাস খেলেছে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.