চারদিক-এখনো কাটেনি আঁধার by শান্তনু চৌধুরী

চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা থেকে টেলিগ্রাফ অফিস হিল রোডের পাশেই চারতলা মহামায়া ডালিম হোটেল। জায়গাটায় কেমন যেন গুমোট ভাব। স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে। পাশে ডাস্টবিন, খোলা দোকানপাট। এর পরও কেমন যেন ডালিম হোটেলের সামনে এসেই নীরবতা।

সন্ধ্যারাতে নিয়ন আলো জ্বলে উঠলেও আলো-আঁধারির খেলা চলে সব সময়। আর হবেই বা না কেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি ও তাদের এদেশীয় দোসররা যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তার অনন্য সাক্ষী এ ডালিম হোটেল। এখনো যেন গুমরে ওঠে একসঙ্গে হাজারো মানুষের আর্তনাদ। অভিনব কায়দায় নির্যাতন আর হত্যার সাক্ষী এ হোটেলের প্রতিটি কক্ষ। এখনো সে স্মৃতি ভুলতে পারেন না প্রত্যক্ষদর্শীরা।
মহামায়া ডালিম হোটেলের লোহার বেষ্টনী দেওয়া গরাদের ভেতরে এখনো অন্ধকার। সিঁড়ি খুঁজতে হয় হাঁতড়ে। সিঁড়ি বেয়ে বাড়িতে প্রবেশের আগে কথা বলে নিই আশপাশের দোকানিদের সঙ্গে। তাঁরা জানেন, এ হোটেলে একসময় পাকিস্তানি সেনারা নিরস্ত্র বাঙালিদের ধরে এনে কীভাবে নির্যাতন করত, তার কাহিনি। গোপাল দাশ নামে এক দোকানি জানালেন, প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি দোকানদারি করছেন। তাঁর মনে হয়, এ এলাকাটা অভিশপ্ত। এখানে এখনো কান্নার শব্দ শোনা যায়। তিনি বলেন, ‘আমি মাঝে মাঝে অনেকের কাছে কাহিনি শুনি। সেগুলো শোনার পর বাড়িটির দিকে একবার তাকাই। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলি।’ কথা হয় হোটেলের নিচে থাকা কবিরাজ গুরুচরণ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি হদিস দিলেন হীরালাল নাথের। যিনি পাকিস্তানি আর তাদের দোসরদের হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষার পর তাঁর দেখা মিলল। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের কথা উঠতেই তিনি বললেন, ‘ডালিম হোটেল মূলত ছিল আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প। আমি হোটেলের একটি কক্ষে থাকতাম। তারা যখন এ হোটেলে আসে, তখন এটি ছিল সম্পূর্ণ খালি। ঘরের বাসিন্দারা সবাই পালিয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী ও আলবদর বাহিনী এসে প্রথমে আমাকে ধরে। আমি তখন বিভাগীয় প্রশাসনের অফিসে চাকরি করি। চাকরির কারণে তারা আমার কোনো ক্ষতি না করে হুঁশিয়ার করে দেয়—মুক্তিবাহিনী এলে যেন তাদের খবর দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকালে দেখতাম, তারা ট্রাকে করে মানুষ নিয়ে আসত। এদের চোখ বাঁধা থাকত। রাত ১০টার পর থেকে শুরু হতো নির্যাতন। রাত যত গভীর হতো, নির্যাতনের মাত্রা তত বাড়ত। গভীর রাতে নির্যাতিতদের আর্তনাদ এত বাড়ত যে কান পাতা দায়। আলবদর ও পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা কাউকে গুলি করে মারতে শুনিনি। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যন্ত্রণা দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। রাতে নির্যাতন করে যাদের মারা হতো, সকালে তাদের লাশ আবার ট্রাকবোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হতো। প্রতিদিন চলত এ নির্যাতন। তাদের নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার কারণে আমি বাসায় থাকতাম না।’
এসব কথা বলার পর হীরালাল দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আবার অতল ভাবনায় ডুবে যান তিনি। শুরু করেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী আগস্টে আসে। ১৫ ডিসেম্বর চলে যায়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে আলবদর বাহিনীও পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় একটি কক্ষে আটকে থাকা লোকজনকে ছেড়ে দিতে বলে। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় মুক্তিবাহিনী তাদের মুক্ত করে।’
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ তদন্ত দল সেখানে গিয়েছিল তদন্ত করতে। সেখানে নির্যাতন করা হয়েছে তৎকালীন ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন এ খানকে (প্রয়াত)। তাঁর স্ত্রী মহিলা পরিষদের নেত্রী নূরজাহান খান অপরাধ তদন্ত দলকে জানিয়েছেন, সেখানে তাঁর স্বামীকে কেমন করে নির্যাতন করা হতো। জানালেন, তাঁর স্বামী তাঁকে বলেছিলেন, ওখানে সব ভয়ংকর নির্যাতন করা হতো। বাসি খাবার দেওয়া হতো। ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো।
মহামায়া ডালিম হোটেলের ফলকটা এখানো মুছে না গেলেও ভবনের খোদাই করা পলেস্তারা উঠে গেছে। দরজা-জানালাগুলোতে উইপোকা। ডালিম হোটেলের ভেতরে ব্যাচেলর বাসা ও দোতলায় একটি পরিবারকে বাসা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাড়িটির মালিক মোহন চন্দ্র নাথের বড় ছেলে অরুণ নাথ এখন সেগুলো দেখাশোনা করেন। সে সময়ের কাহিনিগুলো ভুলে থাকতে চান তাঁরা।
একসময়কার এ ডালিম হোটেলের ইতিহাস অনেকে ভুলতে বসেছে। আর সবাই যদি ভুলে যায়, তাহলে কীভাবে বিচার হবে যুদ্ধাপরাধীদের?
শান্তনু চৌধুরী

No comments

Powered by Blogger.