দুই চাকায় বাংলাদেশ by রয়া মুনতাসীর

আশপাশের অনেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছেন। একটি মেয়ে, সেও আবার সাইকেল চালাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শোনা গেল মন্তব্যটি। আরে, মেয়েমানুষ সাইকেলে ঘুরছে!!! এ বাক্যটি যেন মেয়েটির জন্য নিত্যদিনের সঙ্গী। তবে না শোনার ভান করেই চলতে হয়।

সব কথা কানে নিলে কখনোই হয়তো পূর্ণ করতে পারতেন না সাইকেলে বাংলাদেশ ঘুরে দেখার স্বপ্নটি।
অ্যাঞ্জেলা চৌধুরী। সাইকেল চালিয়ে ঘুরে দেখেছেন বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা। গাড়ি, মোটরবাইক বা বাসে করে নয়, সাইকেল চালিয়ে চক্কর দিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের এক মাথা থেকে আরেক মাথা। তবে একদম একা নয়, সঙ্গে ছিলেন স্বামী দিলীপ চৌধুরী, খন্দকার আহমেদ আলী ও গোলাম মঞ্জুর। কিছু কারণবশত গোলাম মঞ্জুর ভ্রমণটিতে শেষ পর্যন্ত থাকেননি। ‘স্বাধীন পাখির মতো মনে হয়, যখন সাইকেলে করে ঘুরি। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল সাইকেলে চেপে পৃথিবী ঘুরব। এ তো মাত্র শুরু। এখনো বাকি আছে অনেক পথ।’ অ্যাঞ্জেলার চোখ দুটি হেসে উঠল এ কথাগুলো বলার সময়।
২০০৫ থেকে ২০১১। স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার কষ্টটুকু বুকে লালন করে আসছিলেন অ্যাঞ্জেলা। ঘটনার সূত্রপাত ব্যালকনি ও ছাদ থেকে। বাবা সাইকেল কিনে দিয়েছেন। তবে শর্ত দিলেন, রাস্তায় চালানো যাবে না। ব্যালকনি আর ছাদের ছোট্ট জায়গাতেই চালানো শুরু। হঠাৎ মাথায় চাপল, সাইকেলে চড়ে ঘুরে দেখবেন পুরো পৃথিবী। দুই দিন না খেয়ে থেকে ঘনিষ্ঠজনদের দিয়ে বলিয়ে রাজি করানো হলো মা-বাবাকে। সেটা ২০০৫ সালের কথা। তখন বয়স মাত্র ১৪ বছর। সাহস এবং পকেটমানির ওপর ভরসা করে চার সদস্যের দলটি বেরিয়ে পড়ল বাংলাদেশ দেখতে। ৩৪টি জেলা দেখার পর ফিরে আসতে হয়েছিল। কারণ, দেশের বিভিন্ন স্থানে তখন গোলমাল হচ্ছিল। মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে এবার মা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলেন। অপেক্ষার অবসান হয়েছে গত বছর। এ লেভেল পরীক্ষা দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলেন দুই চাকার ভ্রমণে। বাবা রোবাইয়াতুন নবী চৌধুরী। মা কোহিনূর সরকার। শারীরিক অসুস্থতার কারণে দুজনই মারা গিয়েছেন ২০০৮ সালে। সে বছরই বিয়ে হয় বন্ধু দিলীপ চৌধুরীর সঙ্গে।
‘২০১১ সালের ২১ অক্টোবর আমরা চারজন বেরিয়ে পড়লাম সাইকেল নিয়ে। চার মাস লেগেছে। এ বছরের ৬ মার্চ নাটোরে গিয়ে আমাদের যাত্রা শেষ হয়। প্রতিটি জেলার এক বা একাধিক স্কুল/কলেজে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পরিবেশ, পর্যটন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মতবিনিময় করার মাধ্যমে তাদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছি আমরা,’ বলেন অ্যাঞ্জেলা। সহায়তা পেয়েছেন অনেকের। কনসোর্টিয়াম প্রাইভেট লিমিটেড এবং চট্টগ্রামের দি অ্যাডভান্সড বাংলাদেশ লিমিটেডের অর্থায়নে এই ভ্রমণের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। ভ্রমণটির সমর্থনে ছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। গত বছর ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলিমউদ্দীন আহমেদ ভ্রমণ উদ্বোধন করেন।
‘বিকেল হয়ে গেছে। একমুঠো ভাত দরকার। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো দোকানে পাওয়া গেল না। কিন্তু খিদেয় অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা। আগের রাতেও ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। অবশেষে খাদ্যের সন্ধান পাওয়া গেল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যের কাছ থেকে। চার মাসের স্মৃতির খাতায় জমা হয়েছে এ রকম অসংখ্য কাহিনি। ভালো এবং খারাপ।’ ছিল বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা। রাস্তার বেপরোয়া যানবাহনগুলো প্রায় সময়ই যেন গায়ে উঠিয়ে দিচ্ছিল। অন্ধকার নেমে এলেই একদম চুপ করে সাইকেল চালাতেন। কাউকে বুঝতে দিতেন না, তিনি একজন মেয়ে। শুনেছেন নানা রকম কটূক্তি। পড়েছিলেন বখাটেদের কবলেও। সঙ্গে অ্যাঞ্জেলা ছিলেন বলে চুপচাপ মার খেয়ে গেছেন স্বামী দিলীপ চৌধুরী। কিছু বলতে গেলে যে বিপদ আরও বেড়ে যাবে। মোকাবিলা করেছেন প্রচণ্ড গরম ও ঠান্ডার। এ বাধাগুলোই প্রতি মুহূর্তে শক্তি দিয়েছে অ্যাঞ্জেলাকে, ইচ্ছেটাকে পূরণ করতেই হবে। ‘জানতাম, অনেক বাধা আসবে। অনেক সমস্যা দেখা দেবে। সবকিছু চিন্তা করেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। যত বেশি এগিয়ে যাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল স্বপ্নটাকে ছুঁয়ে ফেলছি। তবে দিলীপের সহযোগিতা না পেলে এ ভ্রমণ কখনোই সম্পন্ন হতো না।’
২০ বছর পর হয়তো দেখা মিলবে না অনেক মুক্তিযোদ্ধার। ভ্রমণের সময় অ্যাঞ্জেলা তাই ক্যামেরাবন্দী করেছেন প্রতিটি জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার। ইচ্ছে, যখন তাঁরা থাকবেন না, তখন এ সাক্ষাৎকারগুলো দিয়েই বানাবেন ছোটখাটো একটি তথ্যচিত্র। ছড়িয়ে দেবেন নতুন প্রজন্মের কাছে। এর মাধ্যমে জানিয়ে দেবেন কত কষ্টের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। মন ভালো করে দেওয়ার মতো স্মৃতিও আছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা অ্যাঞ্জেলাকে ডেকেছেন মেয়ে বলে। জোর করে হাতে গুঁজে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতার কিছুটা অংশ। জানিয়েছেন, এ কয়টি টাকা অ্যাঞ্জেলার সম্মানী।
এ কয়টি মাসে যেন শিখে ফেলেছেন জীবনের অনেক কিছুই। বাংলাদেশের মেয়েদের স্বাধীনতার অভাবটুকু অনুভব করেছেন প্রতিটি পদক্ষেপেই। প্রতি মুহূর্তেই বুঝেছেন স্বপ্নপূরণের পথটা মসৃণ নয় মোটেও। তবে নিজেকে রীতিমতো ভাগ্যবান মনে করেন তিনি। মুগ্ধ হয়েছেন রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজারের সৌন্দর্য দেখে, মানুষের আতিথেয়তা দেখে। এ মাসের ২৪ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে সাইকেল নিয়ে গাজীপুর থেকে ঢাকায় প্রবেশ করবে তিনজনের এ দলটি। শেষ হবে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ভ্রমণ। তবে সামনে এখনো অনেকটা পথ বাকি। এরপর তো বিশ্বভ্রমণে বের হতে হবে। তার জন্য যেন এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যে ভ্রমণের মাধ্যমে তুলে ধরবেন বাংলাদেশকে। বিশ্বকে জানাবেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল নয়টি মাসের ইতিহাস। এমনটাই স্বপ্ন দেখেন অ্যাঞ্জেলা।

No comments

Powered by Blogger.