শ্রদ্ধাঞ্জলি-মানুষ গড়ার কারিগর by আল মনসুর

পরিবেশ, সমাজ ও পরিবারের ভেতর মানুষ গড়ে ওঠে প্রকৃতির নিয়মে। অনুকূল পরিবেশে একজন মানুষ বিকশিত হতে পারেন বটবৃক্ষের বিশালতায়, তা না হলে উজাড় হতে পারে পুরো বনাঞ্চল। প্রকৃতির নিয়মে একমাত্র মানুষই পারে প্রকৃতিকে সুস্থ, সুন্দর ও প্রয়োজনীয় রূপে সাজাতে।

মানুষের জীবন প্রকৃতির তেমনই একটি পর্যায়, যাকে সাজানোর জন্য প্রয়োজন হয় সঠিক পথপ্রদর্শন, সঠিক শিক্ষা। আর সে কাজটি সম্পন্ন করেন একজন শিক্ষক, যিনি শুধু মানুষকে নয়, সমাজ ও পৃথিবীকে নিয়ে যান সত্য ও সুন্দরের পথে।
আযীম উদ্দিন আহমেদ (১৯০৪-১৯৭৩) ছিলেন এমনই একজন মানুষ, একজন শিক্ষক, জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে যিনি ছিলেন ‘মানুষ গড়ার কারিগর’।
আযীম উদ্দিন আহমেদের জন্ম বাগেরহাটের কচুয়া থানার এক অজগাঁয়ে। সেখানে প্রতিটি মানুষ ছিল নিরক্ষর। সেখানে অতি সামান্য কারণে ঢাল, সড়কি (সুপারিগাছের দীর্ঘ সরু দণ্ডে নির্মিত তীক্ষ বল্লম) নিয়ে এক বংশের সঙ্গে অন্য বংশের রক্তক্ষয়ী লড়াই চলত বংশানুক্রমে।
তেমনই এক নিষ্ঠুর, অশিক্ষিত, বন্য পরিবেশ থেকে শিক্ষাকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন জীবনের যাত্রাপথ হিসেবে।
বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ও বাংলা বিষয়ে তিনি ‘মাস্টার্স’ করেন।
তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। পরবর্তীকালে করটিয়া সা’দত কলেজ এবং জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজে অধ্যাপনার পর শুরু হয় তাঁর ‘অধ্যক্ষ’-জীবন। অধ্যক্ষ হিসেবে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ, সাতক্ষীরা কলেজ, মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ, ভূয়াপুর কলেজে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর গ্রহণ করেন।
একজন শিক্ষক, দক্ষ প্রশাসক এবং সৎ, উদার ও আধুনিক মানুষ হিসেবে প্রতিটি এলাকায় তিনি সম্মানিত ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে।
প্রতিটি কলেজে তিনি যোগদানের পর কলেজ তার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ফল পেয়েছে প্রতিটি পরীক্ষায়। প্রতিটি কলেজেই তিনি গড়ে তুলেছেন নতুন অবকাঠামো, নতুন বিভাগ, শিক্ষার আধুনিক পরিবেশ।
প্রকৃতিপ্রেমী মানুষটি প্রতিটি কলেজে রোপণ করেছেন বৃক্ষ। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজের মহুয়াগাছ, মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজের জামগাছ আজও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে, আপন গৌরবে।
মানুষ গড়ার এই কারিগর একটি সহজ সূত্রে মানুষকে গড়ে দিয়েছেন সত্য ও সুন্দরের জন্য। তিনি শিখিয়েছেন কেমন করে চিনে নিতে হয় জীবনের প্রতিটি ভালো ও মন্দকে। তিনি বলতেন, ‘জীবনে “মন্দ” নিজ থেকে এসে ধরা দেয় সকল প্রাচুর্য এবং সম্ভোগ নিয়ে, কিন্তু “ভাল”কে পেতে হয় এবং ধরে রাখতে হয় সমস্ত জীবনের ত্যাগ এবং সততার বিনিময়ে।’
সস্তা, মোটা কাপড়ের পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এবং চটি পায়ে এই মানুষটি তাঁর ‘কথা’ প্রমাণ করে গেছেন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে।
এই মানুষটির প্রতিটি সন্তান উচ্চশিক্ষিত। তাঁর মেয়ে, এফআরসিএস চিকিৎসক নীলুফার আফতাভী ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং পিজি হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান, একজন অতি সম্মানিত চিকিৎসক। তাঁর বড় ছেলে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’-এর প্রতিষ্ঠাতা, ‘আলোকিত মানুষ’ গড়ার কারিগর।
আযীম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন দক্ষ নাট্যকার। পঞ্চাশের দশকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘পেন’ (PEN) আয়োজিত বাংলা নাটক রচনা প্রতিযোগিতায় তাঁর মা নাটকটি প্রথম স্থান অধিকার করে। তিনি ‘নাট্যবিশারদ’ উপাধিতে ভূষিত হন। সেই প্রতিযোগিতায় সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর বহিপীর নাটকটি লাভ করে দ্বিতীয় স্থান।
মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া গীতিকাব্য অবলম্বনে তাঁর রচিত মহুয়া নাটকটি ষাটের দশকে বাংলাদেশের প্রতিটি মঞ্চে একাধিকবার মঞ্চস্থ হয়েছে। নাটক নির্দেশনায় তাঁর দক্ষতা এবং তাঁর নির্দেশিত মা নাটকের সার্থক মঞ্চায়ন দেখার সুযোগ এই লেখকের হয়েছিল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি তাঁর দুই সন্তানকে দৃঢ় ও আবেগহীন হূদয়ে যুদ্ধে যাওয়ার মুহূর্তে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘মানুষের সুন্দর জীবনের জন্য মানুষকেই জীবন দিতে হয়। আমি জানি, তোমরা জয়ী হবে।’ এবং বিজয়ের দিনে ‘জিউস’ দেবতার মতো, রৌদ্রদীপ্ত নীল আকাশের পটভূমিকায় তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বাধীনতার পতাকা হাতে।
সেই অসাধারণ শিক্ষক, সেই উজ্জ্বল, সৎ, নিরহংকারী, বিনয়ী মানুষটি আজকের এই দিনে, তেয়াত্তরের বাইশে জুন, অমরত্ব বরণ করেন।
আজকের এই দিনে একগুচ্ছ ফুল আর লোবানের গন্ধ পবিত্র করুক তাঁর সমাধিস্থলকে।
আল মনসুর
নাট্যকর্মী, আযীম উদ্দিন আহমেদের ছেলে।

No comments

Powered by Blogger.