মত দ্বিমত-বিরোধী দলকে সংসদে এসে কথা বলতে হবে by হারুন-অর-রশিদ

আগামী নির্বাচন কার অধীনে হবে, এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে বিতর্ক চলছে। এ প্রেক্ষাপটে দুই শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভিমত এখানে ছাপা হলো। বিরোধী দল ও সরকারি দলের মধ্যে অনতিবিলম্বে আলোচনা শুরু হওয়া প্রয়োজন। রাজনীতিতে আলোচনার দরজা কখনো বন্ধ হয় না। এটা রাজনীতিবিরুদ্ধ।
গণতন্ত্রের মানেই হলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। সুপ্রিম কোর্টের রায় একটি উপলক্ষ। এই রায়কে কেন্দ্র করে বিষয়টি রাজনীতির সম্মুখভাগে চলে এসেছে। এ রায় না থাকলেও রাজনীতিকদের এ নিয়ে নতুন করে আলাপ-আলোচনা-পর্যালোচনার যৌক্তিকতা ছিল।
পত্রপত্রিকায় পড়েছি, রায়ে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের একটা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়টা হলো, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল এক অপরিহার্য অংশ। জাতীয় সংসদ হলো সব জাতীয় বিষয়ে আলাপ-আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বিরোধী দল সংসদে যাবতীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে; শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নয়, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা তাদের বক্তব্য তুলে ধরবে—সেটাই সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাশিত।
বিরোধী দল একদিকে বলছে, সুপ্রিম কোর্টের এ ধরনের রায় দেওয়ার এখতিয়ার নেই, আর দিলেও তা মেনে চলার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই; অন্যদিকে জাতীয় সংসদেও তারা অংশগ্রহণ করছে না। মূলত তারা যেটা করছে সেটা হলো, রাজপথের আন্দোলন। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রে আস্থাশীল ও বিশ্বাসী দল, যেসব গণতান্ত্রিক ফোরাম থাকে সেখানে তারা বক্তব্য রাখবে। সেখানে যদি কোনো সমঝোতা না হয়, কিংবা তারা কথা বলতে না পারে, তখনই সর্বশেষ হাতিয়ার হিসেবে রাজপথের বা সর্বাত্মক আন্দোলনের কথা ভাবা যেতে পারে।
তাদের প্রথম যে বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টের রায় দেওয়ার অধিকার নেই, সেটা ঠিক নয়। বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টকে বলা হয় সংবিধানের অভিভাবক। সংবিধানের কোনো বিধানের সঙ্গে যদি কোনো আইন বা বিধির কোনো ধারা সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে সুপ্রিম কোর্টের অধিকার থাকে তাকে অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করার। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা লক্ষ করব, সেখানকার সুপ্রিম কোর্ট সময়ে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রায় দিয়েছেন। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টেরও তেমন অধিকার আছে এবং সেটা স্বীকৃত। তবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরও আমাদের দেশে যাঁরা রাজনীতিবিদ, যাঁরা সরকার পরিচালনা করেন এবং জাতীয় রাজনীতির গতিধারা নির্ধারণ করেন, তাঁদের এই রায়সহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তাঁরা আলোচনার টেবিলে বসলে নিশ্চয়ই একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে পারবেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাজনীতিকেরা উদ্ভাবন করেছেন। সুতরাং তাঁদের উদ্ভাবনী-ক্ষমতার ব্যাপারে আমার আস্থা রয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে প্রায় ২০ বছর এ ব্যবস্থা একটি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। বিচারপতি আবদুর রউফ মাগুরা থেকে কীভাবে চলে এসেছিলেন, তা আমরা স্মরণ করতে পারি। কিন্তু আজকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোই প্রমাণ দিচ্ছে যে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি ঘটেছে। তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে টিকে থাকুক, তা গণতন্ত্রমনস্ক ব্যক্তিরা চাইতে পারেন না। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হলে এর আবশ্যিকতা থাকে না। যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের আন্দোলন হয়েছিল, তখন এটা দু-তিন মেয়াদের জন্য রাখার আলোচনা হয়েছিল।
চূড়ান্তভাবে কী ধরনের ব্যবস্থার অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হবে, সে বিষয়ে রাজনীতিকেরাই সিদ্ধান্ত দেবেন। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মত রেখেছেন যে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রেখে কোনো নির্বাচন হতে পারে না, আমি সে ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিমত দেব না। শুধু এটা বলব, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বিকল্প থেকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ব্যবস্থায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এক ধরনের দ্বৈত শাসন আমরা দেখেছি। এ ধরনের ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে আমরা রাষ্ট্রপতিকে রেখে তাঁর অধীনে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান গড়ে তুলতে পারি। নির্বাচনকালীন মেয়াদে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে প্রশাসন দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। আর নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ। এভাবে একাধিক ফর্মুলা সামনে চলে আসতে পারে। কিন্তু সর্বাগ্রে প্রয়োজন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন মেয়াদে সরে দাঁড়াবেন কি দাঁড়াবেন না, সেটাসহ সব ধরনের আলোচনার জন্যই উভয় পক্ষকে সংসদে বসতে হবে।
ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় সম্পর্কে বলব, ধরে নিতে হবে এই রায় দেওয়া হয়েছে বা দেওয়া হয়নি। আমরা মনে রাখব, কী প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিতর্কিত হয়েছে। চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিএনপি বিচারকদের বয়স বাড়িয়ে বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা পদে যোগ্য করার সিদ্ধান্ত থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। এরপর সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের বিতর্কিত ভূমিকার কারণেই ওয়ান-ইলেভেনের সৃষ্টি হয়েছিল। সুতরাং আপিল বিভাগের রায়কে টেকনিক্যালি দেখার সুযোগ নেই। বিচার বিভাগের কাছ থেকে যদি এই রায় না-ও আসত, তার পরও তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা নিয়ে অবশ্যই আলোচনার দরকার পড়ত। আমি মনে করি না যে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট দেশকে রাজনৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছেন। বরং ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনার প্রেক্ষাপটে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ঠিক রেখে আপিল বিভাগ একটি রায় দিয়েছেন। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা ওয়ান-ইলেভেন থেকে কিছুই শিক্ষা গ্রহণ করেননি, সেটা ভাবতেও খারাপ লাগবে। আমার ধারণা, তাঁরা শিক্ষা নিয়েছেন এবং নেবেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি দুর্যোগ আসে, তাহলে দলমতনির্বিশেষে সবাই যে আক্রান্ত হন, ওয়ান-ইলেভেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আমি আবারও বলব, আমাদের যাঁরা রাজনীতিবিদ রয়েছেন, তাঁদের কখনো কখনো দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে হয়। দেশের স্বার্থকে সামনে রেখে আলোচনার মাধ্যমে এর একটা নিষ্পত্তি তাঁরা করতে সক্ষম হবেন। তবে বড় কথা হলো, এ জন্য মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। ক্ষমতার সমীকরণ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে না দেখে প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক অবস্থান থেকে দেখতে হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থের অবস্থান থেকে দেখতে হবে।
অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ: সহ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.