জনসংখ্যা-আর নাই, বাংলাদেশ আমাদের একটাই by মশিউল আলম

টিলা কেটে প্লট বানিয়ে আবাসন প্রকল্পের দফারফা। প্রতিষ্ঠানের এমডির হাতে হাতকড়া, ১০ লাখ টাকা জরিমানা, তাৎক্ষণিকভাবে পাঁচ লাখ টাকা আদায়। টিলার চূড়ায় যে পুকুর তাঁরা খুঁড়েছিলেন, তা ভরাট করে টিলাটিকে ঠিক আগের প্রাকৃতিক অবয়ব ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ।

এই হলো সিলেটের চাঞ্চল্যকর ‘মলাইটিলা সংবাদ’-এর আপাত যবনিকা। দুষ্ট লোকেরা বাদে সবাই খুশি—প্রাকৃতিক সম্পদ টিলাটি তো রক্ষা পেল। সেই সঙ্গে প্রমাণিত হলো, পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকেরা ঠুঁটো জগন্নাথ নন, চাইলে তাঁরা অনেক কিছুই করতে পারেন; এবং সর্বশেষ শ্লাঘার বিষয় সংবাদকর্মীদের—কে বলেছে, লিখে কিছু হয় না? সংবাদপত্রে অবিরাম লেখালেখির ফলে অকর্মা-অচল কর্তৃপক্ষও যে সচল-সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে এবং শেষমেশ কিছু একটা করতে বাধ্য হয়, মলাইটিলা তারই অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
মলাইটিলা উদ্ধারের উত্তেজনা শেষ হতে না হতে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় স্থান পেল রাজধানীর তুরাগ নদ উদ্ধার অভিযানের ছবি। নদের বুকের ওপর ঘরবাড়ি বানাবে বলে সোয়া চার একর, মানে প্রায় ১৩ বিঘা জমি ভরাট করে ফেলেছে স্টার হাউজিং লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি! পরিবেশ অধিদপ্তর এখন সেই নদ উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে। আশা করা যাক, তাদের এই উদ্ধার অভিযান সাফল্যমণ্ডিত হবে; দখল হয়ে ভরাট হয়ে যাওয়া নদের বক্ষ আবার ফিরে পাবে প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাকৃতিক পরিবেশের ব্যাপারে অত্যন্ত সংবেদনশীল। ঢাকার চারপাশের নদনদী ও জলাভূমিগুলোর জবরদখল বন্ধ করা এবং ইতিমধ্যে দখল হয়ে যাওয়া অংশগুলো পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। খুব কড়া নির্দেশ ছিল। ফলে প্রবল উদ্ধার অভিযান চলেছিল অনেক দিন ধরে। কিন্তু যাকে বলে ‘টেকসই’ উদ্ধার, সে রকম কিছু ঘটেনি। যেসব জায়গা দখলমুক্ত করা হয়েছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে আবার দখল হয়ে গেছে, আরও নতুন নতুন জায়গাও দখল হয়েছে। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ঘরবাড়িসহ নানা ধরনের স্থাপনা। দখলের এ প্রক্রিয়া চলছে অবিরাম। এক মুহূর্তের জন্যও থামার অবকাশ নেই এবং শুধু ঢাকা বা তার আশপাশে নয়, প্রকৃতিগ্রাসের এ প্রক্রিয়া চলছে সারা দেশের প্রতিটি জনপদে, মাঠে, বনে, পাহাড়ে, জলাভূমিতে—সবখানে।
ঘর মানে বাসস্থান। মানুষের মৌলিকতম চাহিদাগুলোর একটি। সেই ঘর বানানোর জন্য মানুষকে যখন টিলার ওপর উঠে পড়তে হয়, যখন নদীর জলধারা রুদ্ধ করে ভরাট করতে হয় বা নষ্ট করতে হয় ফসলের খেত, তখন প্রশ্ন জাগা উচিত, কী বিষয়? থাকার জায়গায় টান পড়ে গেল? (সম্পদ বণ্টনব্যবস্থায় অমানবিক বৈষম্যের কারণে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ গৃহহীন, তারাও এর অন্তর্গত) নিশ্চয়ই, বাংলাদেশে অতি-অবশ্যই টান পড়ে যাচ্ছে থাকার জায়গার। একবার হিসাব করে দেখুন তো, ১৬ কোটি ২২ লাখ মানুষের শুধু দুই পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কত জায়গা দরকার? শুধু তাদের পায়ের ছাপের মোট ক্ষেত্রফল কত হতে পারে? আমেরিকান গবেষকেরা তাজ্জব হয়ে গোল চোখ কপালে তুলে বলেন, ‘আমাদের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের সমানও নয় যে বাংলাদেশ, সেই একরত্তি দেশে ১৬ কোটি মানুষ!’ অবশ্য আমাদের নিজের দেশের নেতা-নেত্রীরা বলেন, এই বিপুল মানবগোষ্ঠী আমাদের মানবসম্পদ। গত বছর জুন মাসে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশে বেশি জনসংখ্যা শক্তির প্রকাশ, এটা কোনো বোঝা নয়। তিনি এও বলেছিলেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আমরা কত দূর পর্যন্ত অগ্রসর হব, সেটা ভেবে দেখতে হবে। সরকারের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদাধিকারীর কণ্ঠে এ রকম মন্তব্য উচ্চারণের তাৎপর্য সম্ভবত এই যে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আর সরকারের অগ্রাধিকারগুলোর অন্যতম নয়। বাস্তবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। ২০০১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪৭। জন্মহার ও মৃত্যুহার কাটাকাটি করে দেখা যাচ্ছে, দেশে প্রতিবছর লোক বাড়ছে গড়ে প্রায় ২৩ থেকে ২৫ লাখ। আন্দাজ করা হয়েছিল, ২০২০ সালে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা হবে ১৭ কোটি, কিন্তু জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের হিসাবে এখনই এ সংখ্যা ১৬ কোটি ২২ লাখ। তার মানে, বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটার জায়গায় এখন বাস করছে এক হাজার ১২৬ জন মানুষ। এ সংখ্যা বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে, প্রতি ঘণ্টায়।
একদল বিজ্ঞানী সম্প্রতি মজার এক হিসাব করেছেন। তাঁরা তৈরি করেছেন একটি কনজামশান-ল্যান্ড ইউজ ম্যাট্রিকস। মানে, মানুষের ভোগের প্রধান পাঁচ ধরনের উপাদানের বিপরীতে পাঁচ রকমের ভূমি ব্যবহারের হিসাব করেছেন। ভোগের বিষয়গুলো হলো: খাবার, বাসস্থান, চলাচল, দ্রব্যসামগ্রী ও সেবা। আর জমির ধরনগুলো হলো: ঘরবাড়ি, কলকারখানা, অফিস-আদালত ইত্যাদি স্থাপনা নির্মাণের জন্য জমি, কার্বন শোষণের জন্য জায়গা, ফসল চাষাবাদের জমি, তৃণভূমি ও জলজ সম্পদ আহরণের ভূমি। এভাবে হিসাব করে তাঁরা বলছেন, পৃথিবীর মোট লোকের সংখ্যা এখন যা দাঁড়িয়েছে (৬৯২ কোটির একটু বেশি), তাতে এক পৃথিবীর সাধ্য নেই এত লোকের ভরণপোষণ করে। এক পৃথিবীতে কুলোবে না, এখন প্রয়োজন দেড়খানা পৃথিবী। অর্থাৎ পৃথিবী নামের গ্রহটিতে মানুষের প্রবৃদ্ধি ঘটছে এত দ্রুতগতিতে যে পৃথিবী তার সম্পদ নবায়ন করার ফুরসত পাচ্ছে না। গ্লোবাল ফুটপ্রিন্ট নেটওয়ার্ক এই অবস্থার নাম দিয়েছে গ্লোবাল ওভারশুট, তারা এটাকে ইকোলজিক্যাল ডেফিসিটও বলছে। এর মানে, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর মানুষের চাহিদা এত বেড়েছে যে প্রকৃতির রিজেনারেটিভ ক্যাপাসিটি বা নিজেকে নবায়ন করার ক্ষমতা সেটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। ফলে পৃথিবীর প্রাণদায়ী প্রাকৃতিক পুঁজি বা লাইফসাপোর্টিং ন্যাচারাল ক্যাপিটাল নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে এবং আবহাওয়ামণ্ডল ভরে উঠছে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো আবর্জনায়।
সবেধন নীলমণি এই একখানা পৃথিবীতে মানুষের প্রবৃদ্ধি যেভাবে চলছে, সেভাবেই যদি চলতে থাকে, তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন পৃথিবী ফতুর হয়ে গিয়ে মানব প্রজাতির বিলয় ঘটাবে। এ ধরনের আশঙ্কার কথা বলছেন সায়েন্স ফিকশন লেখকেরা নন, স্টিফেন হকিংয়ের মতো পদার্থবিজ্ঞানীরাও। হকিং কয়েক মাস আগে বলেছেন, পৃথিবীর সম্পদ ফুরিয়ে যাচ্ছে, মানব প্রজাতি যদি নিজেকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে চায়, তবে তাকে মহাকাশে বসবাসের জায়গার অন্বেষণে বের হতে হবে; উপযুক্ত কোনো জায়গা পেলে সেখানে মাইগ্রেট করতে হবে।
প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ৫২ জন মানুষের পদভারেই নাভিশ্বাস উঠে গেছে পৃথিবী নামের গ্রহটির; ইতিমধ্যে এমনই নিঃস্ব ও ফতুর হয়ে গেছে সে। তাহলে এ পৃথিবীর এক কোণের কোণ তস্য কোণে সরষে দানার চেয়েও ছোট্ট একরত্তি বদ্বীপ আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের কী অবস্থা? জনসংখ্যার দিক থেকে আট নাম্বার দেশ, কিন্তু জমির ভাগ কতটুকু? পৃথিবীকে তিন হাজার ভাগে ভাগ করলে তা থেকে মাত্র এক ভাগ। এখানে এখন প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজার ১২৬ জন মানুষের বাস! সোয়া ১৬ কোটি বাংলাদেশির জন্য তাহলে কয়টি বাংলাদেশ প্রয়োজন? ৫টি? ১০টি? ১৫টি?
প্রয়োজন যা-ই হোক, আর নাই, বাংলাদেশ আমাদের একটাই। জমিও আমাদের এটুকুই। নদী-নালা, খালবিল, ফসলের মাঠ, বনভূমি, জলাভূমি—কিছুই বাড়বে না। বাড়বে শুধু মানুষ! ১৯০১ সালে পূর্ববাংলার লোকসংখ্যা ছিল দুই কোটি ৯০ লাখ। ১৯৫১ সালে চার কোটি ৪০ লাখ। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারিতে জানা গেল স্বাধীন বাংলাদেশের লোকসংখ্যা সাত কোটি ১০ লাখ। ১৯৮১ সালে বেড়ে হলো আট কোটি ৭০ লাখ। ১৯৮৮ সালে ১০ কোটি ৯৯ লাখ...। ১৯০১ সালে প্রতি বর্গকিলোমিটারে মানুষ ছিল ২১৬ জন, ১৯৫১ সালে ৩১২ জন, ১৯৮৮ সালে ৮২১ জন, এখন এক হাজার ১২৬ জন। এ সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ফলে ছোট হয়ে আসছে ফসলের মাঠ, কাটা পড়ছে বন, ভরাট হচ্ছে নদী-নালা, খালবিল...।
এটাকে বলে ইটিং আউট দ্য ফিউচার—ভবিষ্যৎকে খেয়ে ফেলা। যদি কিছু করতে হয়, এখনই সময় শুরু করার।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.