চারদিক-এতিমখানায় গিয়েছিলাম by আজাদুর রহমান

মোনারুল। নিজের শার্টটা এখন নিজেই গায়ে দিতে পারে সে। জামা গায়ে দিতে পারা—এ আর কি এমন! দুটো হাত দুই দিকের হাতার ভেতর চালানোর পর কলাপসিবল গেটের মতো ডান-বাঁয়ের পাল্লা টেনে ঘাট বুঝে ঘর গলিয়ে বোতাম লাগালেই হয়ে গেল। শার্ট কিংবা জামা পরাটা আমাদের কাছে মামুলিই বটে।

কিন্তু নোনামুখি শিশুদের বেলায়! মা স্তন মুখে গুঁজে না দিলে যে নিজের তাকতে খেতে পায় না, তার তো সবই শিখতে হয়। মা মরার সময় মোনারুল তো নোনাই ছিল। কবেকার কথা। মৃত্যু কী? মরার পর সে কী আকাশের তারা হয়ে যায়? বোঝার কথা নয় অতটুকুন বাচ্চার। মৃত মায়ের স্তনেই ঠোঁট রাখল সে। মা আর কোনো দিনও তাকে চুমু খাবে না। সোনামণি জাদুমণি বলে কপালে টিপ দেবে না। যে বয়সে সে মৃত্যুকে বুঝতে শিখবে, তত দিনে মা হয়তো আকাশের তারা হয়ে যাবে। মোনারুল তাই এতিমখানার ছাদে উঠে যায়। চিত হয়ে আকাশের তারা দেখে, তারা গোনে। তারপর কোনো একটা তারাকে মনে মনে মা ধরে নিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দেয়, ‘মা, তুমি কেমন আছ? মা, আমাকে একটু আদর করে দাও। একটা চুমু দেবে, মা?’ মোনারুল একা একাই যেন সাদা মেঘগুলো ভেঙে হাঁটতে থাকে। দুই ঠোঁট দিয়ে কান্না চাপার চেষ্টা করে সে। পারে না। শব্দ করে কেঁদে ওঠে।
সাতক্ষীরা সরকারি এতিমখানায় মোনারুলের মতো আরও কয়েকজন আছে। অন্যদের মা আছে, বাবা নেই। জামাকাপড় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। শিশু সাদ্দামের মুখটা চঞ্চলতায় ভরে গেল, ‘টেলার্স থেকে মাপ নিয়ে গ্যাছে। এখনো জামা হাতে পাইনি।’ আনন্দিত সাদ্দামের পানে চেয়ে কেবলই মনে হলো, খাবার-দাবারের মতো ভালোবাসা কেনা গেলে হয়তো ভালো হতো।
প্রত্যেকের সঙ্গে গাঁথা আছে একটি করে দুঃখগল্প। ইমরানের বাবার কথাই ধরা যাক। কী কারণে যেন পায়ের নখে কাদা ঢুকেছিল। গ্যাংগ্রিন হলো। পা কেটে ফেললেন চিকিৎসকেরা। তাতেই মারা গেলেন তিনি। তুহিনের বাবা মারা গেলেন ট্রাকের নিচে পড়ে। আর সবুজের বাবাকে রাতের বেলা কারা যেন বাঁশচাপা দিয়ে মেরে ফেলল। তারপর ফাঁস লাগিয়ে শোবার ঘরে ঝুলিয়ে রাখল। সবুজের পর আবু সাঈদ বলতে শুরু করল, ‘ডেলিভারির সময় মায়ের জঠর থেকে বাচ্চার হাত বেরিয়ে এসেছিল। ডাক্তার হাতটা কেটেও দিয়েছিলেন; কিন্তু মাকে বাঁচানো যায়নি। বাবা ফের বিয়ে করল। আবু হাসানের জন্ম হলো। তারপর একদিন বাবাও গলায় দড়ি দিল।’ আবু সাঈদ ও সৎভাই আবু হাসান দুজন এখন এখানেই। বেদনা বিয়োগের গল্পগুলো শুনতে শুনতে মনটা ক্রমেই ভারী হয়ে আসে। মন ফেরানোর জন্য হালকা কথা বলতে শুরু করলাম। কিন্তু ওদের নরম বুকে দলাপাকানো কষ্টটা গলল না। অন্য বাচ্চারা জড়ো হলে যেমন পরস্পর অকারণে হাসে, ছটফট ভাব করে, এখানকার একটা বাচ্চাও তেমন নয়। একটি ছেলেও শব্দ করে হাসল না। হয়তো আরও মজা করতে চাইতাম; কিন্তু কচি মুখগুলোর ওপর বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারলাম না। কারও মুখ এমন মোলায়েম আর ম্লান যে চোখে পানি এসে যায়। দেহের ভার সইবার মতো যাদের বয়স হয়নি, তারা এত বেদনার ভার বয় কীভাবে!
মেলাতে না পেরে ভাবনা মাথায় বসে থাকি। সাত-আট বছরের পাতলা সেলিম ঠিকমতো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ভয়ে ভয়ে কথা বলে। নিচু মাথায় স্বপ্নগুলো বলে যায়, ‘আম্মা আসবে। আম্মা এখন পুলিশের খাবার রেন্দে দেয়। আমি বড় হয়ে আম্মারে ভালোভাবে দেখপো, জিনিসপত্র কিনি দেব।’ সবুজ, আখতারুল, সাদ্দাম, তুহিন, কবির—সবার বুকেই দলাপাকানো কষ্ট আছে। আমি নতুন করে কিছুই আর শুনতে চাই না। কিন্তু ইসমাইল এগিয়ে এসে গলা তোলে। ছোটবেলার কথা। বাবা কাউসার গায়েনের আগে থেকেই কিছুটা মানসিক সমস্যা ছিল। এক রাতে হঠাৎই মাথাটা বিগড়ে গেল। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। কাউসারের যেন কী হলো, বাঁশ দিয়ে ঘুমন্ত মা-বাবাকে আঘাত করে বসলেন। উপর্যুপরি আঘাতে মা-বাবার মৃত্যু নিশ্চিত করে স্ত্রীকেও একইভাবে বাঁশের বাড়ি দিয়ে মেরে ফেললেন তিনি। পরদিন পুলিশ এসে কাউসারকে ধরে নিয়ে গেল। দৃশ্যগুলোর জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। ইসমাইলরা চার ভাইবোন, সবাই পাথর হয়ে গেল। বাবা কাউসার অনেক দিন জেলে ছিলেন। এ জন্য ইসমাইল বাবাকে দোষ দেয় না, বাপে তো পাগল ছিল। মাঝেমধ্যে ইসমাইল তাই বাবাকে দেখতে জেলখানায় যেত। কথাবার্তা বলতে বলতে একসময় বাবা-ছেলে দুজনই কাঁদতে শুরু করত। পরে জেলেই বাবা মারা গেল।
ইসমাইল সব বলতে পারল না। ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। এতটুকুন বাচ্চাকে কী ভাষায়, কী বলে সান্ত্বনা দেব আমি? ইসমাইলের সামনে দাঁড়িয়ে অপরাধীর মতো খামাখাই হাতড়ে বেড়াতে লাগলাম নিজেকে। তারপর কোনো সান্ত্বনা খুঁজে না পেয়ে আনমনেই ওদের একজনের মাথায় হাত বোলাতে লাগলাম। আশ্চর্য, মনমরা এ শিশুদের মাথার চুলেও আমাদের বাবুদের মতো একটা স্নেহমাখা বুনো গন্ধ আছে! আমি দাঁড়িয়ে থেকেই হাত দিয়ে ছুঁতে পাচ্ছি ওদের এলোমেলো চুল। টের পাচ্ছি বুনো গন্ধ।
আজাদুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.