ভাষা-মায়ের ভাষার মৃত্যু হবে না কোনো দিন by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

অধ্যাপক সের্গেই সেরেব্রিয়ানির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ঢাকায় অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। সেদিন ছিল আমার বিদায়ী সম্ভাষণ দেওয়ার কথা। আমি মৎসংকলিত টোয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি স্পিকস ফর অল ল্যাংগুয়েজেস-এর কয়েকটি কপি নিয়ে গিয়েছিলাম বিদেশি কয়েকজন গুণী ব্যক্তিকে দেওয়ার জন্য।


আমার উদ্দেশ্য ছিল, যেসব মাতৃভাষার ওপর আমি কবিতা সংগ্রহ করতে পারিনি, তার একটা কিনারা করা। অধ্যাপক সেরেব্রিয়ানিকে বইটা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত আছে তো?’ আমি দারুণ খুশি! সমঝদার বটে। আমি বললাম, আমি ষাটটি ভাষায় মাতৃভাষার ওপর কবিতা সংগ্রহ করেছি, কিন্তু বাকি অন্যান্য ভাষার সঙ্গে উজবেক ও ইউক্রেনি মাতৃভাষার ওপর কোনো কবিতা সংগ্রহ করতে পারিনি। তিনি চেষ্টা করবেন বললেন। আমি ই-মেইলে তাঁকে মনে করিয়ে দিই। তিনি উজবেক ভাষায় একটা কবিতা পাঠিয়ে বলেছিলেন, তিনি কবিতাটির অনুবাদ করতে পারবেন না, ঢাকায় কারও সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আমি দু-একজনকে বলে কোনো উপায় করতে না পেরে, আবার তাঁকে লিখলাম। এবার তিনি তাঁর দুজন উজবেক সহকর্মীর সাহায্যে কবিতাটির প্রতিটি শব্দ রুশ ভাষায় ভাষান্তরিত করে তার আবার ইংরেজি করে পাঠিয়েছেন।
সের্গেই ডি. সেরেব্রিয়ানি (জন্ম ১৯৪৬) মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে হিন্দি, বাংলা, উর্দু ও সংস্কৃত ভাষা অধ্যয়ন করেন। বিদ্যাপতি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর তাঁর সন্দর্ভ রয়েছে। বর্তমানে তিনি ঘরে বাইরে উপন্যাসের অনুবাদ করছেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে তিনি এক প্রকল্পে হায়াৎ মামুদ ও দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে কাজ করেন। ১৯৭৫ সালের আগস্টের অভ্যুত্থানের পর সেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আজাদ সামাতভ (জন্ম ১৯৪০) উজবেক কবিতাটি রুশ ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ভাষার ওপর গবেষণা করেন। উজবেকিস্তান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বের সহকারী অধ্যাপক ড. নাসির কামারভও এই অনুবাদে সাহায্য করেন।
আমি সেই উজবেক>রুশ>ইংরেজি থেকে একটা বাংলা অনুবাদ দাঁড় করালাম।

আমার মায়ের ভাষার মৃত্যু হবে না কোনো দিন
এরকিন ওয়াহিদভ (জন্ম ১৯৩৬)

একজন বলিয়ে বললেন, ‘এ-ই নিয়তি! অন্তিম বিশ্ব ইতিহাসের এ-ই ইচ্ছা।
সব ভাষাই তো হারিয়ে যাবে, এ দুনিয়ায় শুধু টিকে থাকবে একটি ভাষা।’

‘ফক্কড় ফাজিল, থামো। কোথায় তুমি এ বাজে জিনিস পেলে?’
নাভোয়া ও পুশকিন তাঁদের কবর থেকে উঠে এলেন।

রুষ্ট ও অবাক হয়ে উঠলেন একে একে
দান্তে, মিলার, বায়রন, ফিরদৌসী, বালজাক আর রবিঠাকুর।

‘তোমার ফতোয়া বন্ধ করো, ভাই। তুমি যা বলছ তা ঘটবে না কোনো দিন।’
সকলে সমস্বরে বলেন, ‘আমার মায়ের ভাষার মৃত্যু হবে না কোনো দিন।’

‘হায়, কী আজব কথা!’ পবিত্র পেয়ালা হাতে
খৈয়াম কিরাত করেন এক রুবায়েত ফারসি ভাষাতে।

সাশ্রু নয়নে, বেরঁজে জিজ্ঞাসে মহা আবেগে,
‘তুমি বলছ, একদিন ফরাসি ভাষাও মারা যাবে?’

সারভেনতিসের সাথে নেরুদা ও লোরকা দাঁড়িয়ে ওঠে
‘কার এত বড় সাহস, আমার ভাষাকে হানতে চায় তীক্ষ তলোয়ারে?’

ক্রুদ্ধ ফাইজুলি রেগে চিৎকার করে বলে, ‘আজেরি ভাষা ফুলের মতো খসে পড়বে না।’
সকলে সমস্বরে বলে, ‘আমার মায়ের ভাষার মৃত্যু হবে না কোনো দিন।’

আমাদের ভাষাদের নানা রঙে রামধনু রাঙাতে
শত শত বছর ধরে আমরা কষ্ট সয়েছি, হাজার হাজার বছর ধরে যন্ত্রণা।

আমাদের ভাষাকে মধুময় করতে যে কষ্ট করেছি, সবই কি যাবে বৃথা?
যদি তা-ই হয়, হায়, কবরে আমাদের জন্য তো থাকবে না কোনো শান্তি।

ফাউস্ট স্ফুলিঙ্গের মতো ফেটে পড়ে, হামাশ আগুন জ্বালায়,
একটি কণ্ঠস্বর সারা পৃথিবীব্যাপী পাহাড় ডিঙিয়ে তোলে প্রতিধ্বনি।

এই কণ্ঠস্বর চিরদিন শোনা যাবে এবং স্তব্ধ হবে না কোনো দিন
সারা পৃথিবী বলে, ‘কখনো না। আমার মায়ের ভাষার মৃত্যু হবে না কোনো দিন।’

 মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।

No comments

Powered by Blogger.