এই সময়-রাজনীতি ও রাজনীতিকদের বচন by মাহফুজ মিশু

রাজনৈতিক মতভিন্নতা পৃথিবীর সব দেশেই আছে। সেখানেও রাজনীতিবিদরা পরস্পর আক্রমণ করেন, তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু সেখানে তারা শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেন না। অন্যকে অশ্রদ্ধা, অসম্মান করেন না। তাই রাজনীতিবিদদের শব্দচয়নে আরও সতর্ক হওয়া জরুরি সুন্দর কথায় কী না হয়! ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্র্রীয় জীবন_ সবখানেই সুবচনের জয়জয়কার।


যাদের কথা আমাদের প্রতিদিন শুনতে হয়, যাদের কথার ওপর ভর করে নির্ধারিত হয় আমাদের ভাগ্য, আমাদের নেতা-রাজনীতিবিদ সেসব মানুষের কেউ কেউ যেন পণ করে বসেছেন, তারা ভালো কথা বলবেন না, ভালো করে কথা বলবেন না। কথা বলবেন এমন স্ব্বরে যেন তা কাউকে না কাউকে আঘাত করে, বিশেষ করে প্রতিপক্ষকে। সম্প্রতি সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সেই সুরে কথা বলছেন, যেই সুর এ দেশের মানুষ পছন্দ করে না; অপমানিত বোধ করে, কষ্ট পায়। ধরা যাক সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কথা। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের অমানুষিক নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশ আর কয়েক দিনের ব্যবধানে সাতজন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনায় সৈয়দ আশরাফ তার প্রতিক্রিয়ায় বললেন, 'সীমান্তের ঘটনা নিয়ে চিন্তিত নয় সরকার।' কী অদ্ভুত! সরকারের মুখপাত্র তিনি। এ কথা শোনার জন্যই কি আশরাফ সাহেব, এ দেশের মানুষ আপনাদের এত বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে? এখানেই শেষ নয়। এ ঘটনার সপ্তাহ পার না হতেই জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ বলে বসলেন, 'অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট। এটা নিয়ে এত প্রতিবাদের কী আছে?' যেসব মা তাদের সন্তানকে সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন, সেই সব মা এ কথা কীভাবে সহ্য করবেন? আর কে না জানে, আমাদের দেশে প্রতিদিন যে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, তার কারণ অদক্ষ চালক, অপ্রশস্ত রাস্তা, হাইওয়ে পুলিশের অভাবসহ আর অনেক কিছু। নিঃসন্দেহে এসব জায়গায় অনেক কিছুই করার ছিল সরকারের। মনে পড়ে বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী শিশু নওশীনের মৃত্যু প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে।' সময় পাল্টেছে; পাল্টেছে সরকারি দল আর বিরোধী দলের অবস্থান। কিন্তু যা পাল্টায়নি তা হলো, সাধারণ মানুষকে দেখার চোখ, হৃদয়। সম্ভবত তাই বিপরীত মেরুর নেতাদের কথাবার্তায় কী দারুণ মিল!
এবার আসা যাক প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথায়। গত ৩১ জানুয়ারি তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক জনসভায় বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলে ফেললেন, 'আপনার সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানও ব্যর্থ হবে। দুই ক্লাস কম ম্যাট্রিক পড়ে গণঅভ্যুত্থান করা যায় না।' খুব নিশ্চিত করেই বলা যায়, দেশের প্রবীণ এই রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে এ রকম অসম্মানজনক বক্তব্য কেউ আশা করেনি। পুলিশের পিটুনিতে আহত হয়ে বিদেশ থেকে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলেছিলেন, 'আমরা ক্ষমতায় গিয়ে আপনার মেরুদণ্ড ভেঙে দেব।' কী স্পর্ধা, কী অসভ্যতা! এ রকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মোদ্দা কথা হলো, এভাবে অশালীন, অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে না দেশের মানুষ। তারা পকেটের টাকা দিয়ে বিদ্যুতের বিল, ডিশ লাইনের ভাড়া দিয়ে রাতে যখন টেলিভিশনের সামনে বসে, তখন ভালো কোনো খবর না হোক অন্তত এ জাতীয় বাক্য শুনতে চায় না। আপনারাই এ দেশের মানুষকে আশার কথা শোনাবেন, তাদের দিন বদলাবেন। রাজনৈতিক মতভিন্নতা পৃথিবীর সব দেশেই আছে। সেখানেও রাজনীতিবিদরা পরস্পর আক্রমণ করেন, তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু সেখানে তারা শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেন না। অন্যকে অশ্রদ্ধা, অসম্মান করেন না। তাই রাজনীতিবিদদের শব্দচয়নে আরও সতর্ক হওয়া জরুরি। আপনারা আমাদের নেতা। এই দেশটির দায়িত্ব ভোটের মাধ্যমে আমরাই আপনাদের দিয়েছি এবং আবারও আপনাদের সাধারণ মানুষের কাছেই আসতে হবে। কারণ ভোট তো তারাই দেয়, হয়তো তা পাঁচ বছরে একবার। কিন্তু সেই ভোটই তো আপনাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে।

মাহফুজ মিশু : মহাসচিব, বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশন
mahfuzmishu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.