ভূমিকম্প ও বাংলাদেশ-প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই

আতঙ্কের ভূমিকম্পে আবার কাঁপল দেশ। গত রবিবার সন্ধ্যায় সারা দেশে একযোগে অনভূত হয়েছে ভূমিকম্প। ৬০ বছরের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু উৎপত্তিস্থলের দূরত্বের কারণে এবার দেশে বড় কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিকিমের গ্যাংটক থেকে ৬৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে।


ঢাকা থেকে ভূমিকম্প উপকেন্দ্রের দূরত্ব ছিল মাত্র ৪৯৫ কিলোমিটার। আর ভূকম্পনের কেন্দ্র ছিল মাটির প্রায় ২০ কিলোমিটার নিচে।
ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ। অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে, উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ২০ জেলা। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, মানচিত্রে পুরো দেশকে উচ্চ, মধ্যম ও নিম্নমাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে তিনটি জোনে ভাগও করা হয়েছে। সর্বাধিক ঝুঁকিতে থাকা ওই ২০ জেলা পড়েছে প্রথম জোনে. যা দেশের ৪৩ শতাংশ এলাকা। ২ নম্বর জোনে পড়েছে দেশের ৪১ ভাগ এলাকা। গবেষকরা অনেক আগেই জানিয়েছেন, বাংলাদেশে আটটি ভূতাত্তি্বক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে। আর ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ পরিচালিত 'রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অব আরবান এরিয়াস এগেইনেস্ট সিসমিক ডিজাস্টার (রেডিয়াস) জরিপে ভূতাত্তি্বক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে অন্যতম ঢাকা। আমাদের সৌভাগ্য, এবারের ভূমিকম্প দেশে কোনো বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারেনি। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ঘরবাড়ি থেকে নামতে গিয়ে কিছু মানুষের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কয়েকটি স্থানে দালান হেলে পড়ার খবরও এসেছে। এবার ক্ষয়ক্ষতি দৈবক্রমে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে বলে ভবিষ্যতেও যে তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে_এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেহেতু ঢাকা বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ ২০ শহরের অন্যতম, স্বাভাবিকভাবেই রাজধানী ঢাকার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। রাজধানী ঢাকার আকাশ দিনে দিনে ঢেকে যাচ্ছে। গড়ে উঠছে বড় বড় দালান। অন্যদিকে রাজধানীকে আমরা একটি জ্বলন্ত চুলি্লতে পরিণত করেছি। রাজধানীর মাটির নিচে গ্যাসের পাইপলাইন রয়েছে। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ ঘটে গেলে সে ক্ষেত্রে বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপের পাশাপাশি পাইপলাইন ফেটে গেলে দুর্যোগ আরো বাড়বে। এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় কি আমাদের আছে? নগরায়ণ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। তবে এই নগরায়ণকে নিয়মিত মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। বিল্ডিং কোড মেনে শহরের বাড়িঘর নির্মাণ হচ্ছে কি না, নির্মাণকালে ভূমিকম্প রোধক ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে। অন্য অনেক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতির ব্যাপারে বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়েছে। পাশাপাশি এটাও স্বীকার করতেই হবে, ভূমিকম্প-দুর্যোগে আমাদের প্রস্তুতি এখনো অপ্রতুল। সরকার ইতিমধ্যে ভূমিকম্প-দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে। এই দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসকল্পে জাতীয় পর্যায়ে, সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর জন্য জরুরি সাড়াবিষয়ক পরিকল্পনাও প্রণয়ন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখন মাঠপর্যায়ে মহড়ার মাধ্যমে এই পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শুধু সরকারের একক বিষয় নয়। এটি প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ দায়িত্ব। তাই ভূমিকম্প-দুর্যোগের ঝুঁকিহ্রাসে প্রত্যেক নাগরিককে যেমন এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত ঝুঁকি হ্রাস-সংক্রান্ত সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নগরবাসীকে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত করতে হবে। আমরা ঝুঁকিতে আছি, এই সত্য মেনে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.