সাদাকালো-রাস্তাঘাট মৃত্যু দুর্নীতি নিয়ে কিছু কথা by আহমদ রফিক

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের এক যৌথ সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য-উপাত্তভিত্তিক প্রমাণ পাওয়া গেলে তার মন্ত্রিত্ব থাকবে না। তিনি মূলত মন্ত্রিপরিষদ নিয়েই এ কথা বলেছেন।


কারণ কিছুদিন ধরে পত্রপত্রিকায় দুই মন্ত্রী সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে। শহীদ মিনারে ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী সমাজের সভা-সমাবেশে দুই মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠেছে, হয়েছে মানববন্ধন। সেসব প্রতিবাদের ইঙ্গিতেই কথাগুলো বলেছেন তিনি।
হঠাৎ করেই দেশজুড়ে যোগাযোগমন্ত্রী ও নৌপরিবহনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পদত্যাগের দাবির কারণ ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দুই খ্যাতিমান ব্যক্তি চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরের সড়ক দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যু। এ ঘটনা দেশবাসীকে খুবই নাড়া দিয়েছিল। আবেগের ব্যাপক প্রকাশ ঘটে শহীদ মিনারে তাঁদের শবদেহ ঘিরে।
এর আগে অনেক মৃত্যু ঘটেছে একাধিক সড়ক-মহাসড়ক দুর্ঘটনায়। সেসব জনমনে এতটা সাড়া ফেলেনি। বেশ কয়েক বছর আগে অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এবং দুর্ঘটনায় শোকাবহ মৃত্যু রোধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন; কিন্তু তৎকালীন সরকার তাতে কান দেয়নি। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধের জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা বা পরিকল্পনা নেওয়ার কথা ভাবেনি, কোনো আগ্রহও দেখায়নি।
এমনকি দুর্ঘটনার কারণ নির্ধারণের চেষ্টাও করা হয়নি। রাস্তার বেহাল দশার পাশাপাশি বাস বা ট্রাকচালকের বেপরোয়া চালনা, বিশেষ করে নিয়মবহির্ভূত দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, রাস্তার বাঁকে গতি কমানোর অনিচ্ছা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনার কথাও মাথায় আসেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। ইলিয়াস কাঞ্চনের ঘটনার পরও অনেক রক্ত ঝরেছে মহাসড়কে, জনপথে। কাগজে খবর বেরিয়েছে, এ পর্যন্তই। এমনকি খানাখন্দে ভরা ভাঙাচোরা রাস্তার ছবিও ছাপা হয়েছে একাধিক দৈনিকে; কিন্তু বিগত সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর অধিদপ্তর কোথাও সাড়া জাগেনি। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু তাদের চোখে স্বাভাবিক মনে হয়েছে।
যান দুর্ঘটনায় কিছুসংখ্যক মৃত্যু_বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীর শোকাবহ মৃত্যুর ঘটনায় রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বেপরোয়া বাস চালনায় মৃত্যুর জন্য চালকের চরম শাস্তির ব্যবস্থাসংবলিত আইন পাসের চেষ্টা করেছিলেন। সন্দেহ নেই, এটা ছিল একটি সঠিক পদক্ষেপ। কারণ কয়েকটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হলে চালকদের মধ্যে সচেতনতা দেখা দিত। তাদের মধ্যে এমন বোধ জাগত, যেকোনো মৃত্যুই সংশ্লিষ্ট পরিবার ও অন্য সবার জন্যই শোকাবহ ঘটনা। নিছক অবহেলা বা খেয়ালখুশিতে কারো মৃত্যু ঘটানো অমার্জনীয় অপরাধ। একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার যেভাবে বিচার সম্পন্ন হয় তেমনি আইনেই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুরও বিচার হওয়া উচিত।
এসব দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা হত্যাকাণ্ডই বিবেচনা করি। করি যখন চালকের দায়িত্বজ্ঞানহীন বেপরোয়া গাড়ি চালনা, অবহেলা কিংবা মাদকাচ্ছন্ন অবস্থায় গাড়ি চালানোর (যার প্রমাণ কখনো কখনো মেলে) ফলে সংঘটিত মৃত্যু ঠিক দুর্ঘটনা নয়, এর নৈতিক ও বস্তুগত দায় একান্তভাবেই চালকের। সে বিবেচনায়ই ওই ধরনের মৃত্যু ঘটানোর জন্য দায়ী ব্যক্তির বিচার হওয়া উচিত।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি, এখনো হচ্ছে না। রাষ্ট্রপতি এরশাদ বাস-ট্রাক মালিক (মূলত বাস মালিক) সমিতি ও চালকদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে ওই আইন নিয়ে এগোতে পারেননি। এবার মিশুক-মাসুদের মৃত্যু উপলক্ষে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তাতে কাগজে লেখালেখি এবং নিহতদের স্বজন কারো কারো প্রতিক্রিয়ায় একই ধরনের শাস্তির দাবি উচ্চারিত হয়েছিল। একজন বলেছিলেন, এ মৃত্যু হত্যাকাণ্ড।
কিন্তু দিন কয়েক আগে কাগজে দেখা গেল এ ধরনের বেপরোয়া চালনার ফলে মৃত্যুর কারণে চালকের দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ডের (অবশ্য সুবিচার সাপেক্ষে) আইন বিধান নিয়ে ভাবা হচ্ছে। এতে জনসাধারণের আবেগের মূল্য নাই থাক মৃত্যুর যথাযথ আইনি বিচার যে নিশ্চিত হবে না বলাই বাহুল্য। আমরা আবারও বলি, চরম ঘটনার জন্য চরম শাস্তির কিছু ব্যবস্থাই চালকদের আপন দায়িত্বে সতর্ক হতে সাহায্য করবে।
এ প্রসঙ্গেই এবং বিশেষভাবে তারেক-মিশুকের মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বিগ্ন মানুষের এবং সংবাদপত্রের সমালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে সড়ক-মহাসড়কের বিপজ্জনক চেহারা। সত্যি বলতে কি, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের খানাখন্দ-গর্ত সংবলিত দু-একটি ছবি দেখে আঁতকে উঠতে হয়েছে। কারণ এমন রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার অর্থ প্রাণ হাতে নিয়ে যাত্রা। আর এসব কারণেই যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। দাবি করে তাঁর পদত্যাগের।
প্রধানমন্ত্রী হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন যে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিই উচ্চারিত হয়েছে। এরপর নানা আলোচনায় এবং নৌপরিবহনমন্ত্রীর ড্রাইভারদের ঢালাও লাইসেন্স প্রদানসংক্রান্ত কিছু বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর পদত্যাগের দাবি ওঠে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও উল্লেখ করেছেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার গুরুত্ব এবং তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ইত্যাদি।
দুর্নীতির প্রসঙ্গ এসেছে পরে রাস্তার বেহাল দশা ও গত দুই বছরে তা যথাযথভাবে দেখভাল না করা এবং লাইসেন্স প্রদান প্রসঙ্গ ঘিরে। জন-অসন্তোষের এ উত্তাপে জ্বালানি যোগ করেছে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মন্ত্রিবিষয়ক মন্তব্য এবং উইকিলিকসের ফাঁস করা বার্তা। তখনই শুধু দুর্নীতির প্রসঙ্গ, রাস্তার বেহাল দশা ও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
আমরা প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের সঙ্গে একমত যে প্রমাণ ছাড়া কাউকে দুর্নীতিবাজ বলা যেমন ঠিক নয়, তেমনি প্রমাণ ব্যতিরেকে কাউকে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণও সঠিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন থাকে যে রাস্তা মেরামতের বা লাইসেন্স প্রদান বা সরকারি পর্যায়ে যেকোনো প্রকার দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত কিভাবে সাধারণ মানুষ খুঁজে পাবেন বা তাদের হাতে আসবে? এটাতো একধরনের অসম্ভব বিষয়।
সে ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রশ্ন যখন উঠেছেই তখন একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই পারেন তাঁর নিজস্ব পন্থায় তদন্ত করে নিশ্চিত হতে যে অভিযোগ সত্য না মিথ্যা। মিথ্যা হলে তিনি অভিযোগকারীদের একহাত নিতে পারবেন। তার চেয়ে বড় কথা, এ ধরনের তদন্ত (তা গোপনে হলেও) একদিকে মন্ত্রিসভার স্বচ্ছতার দিকটা তুলে ধরবে, অন্যদিকে জনগণের কাছে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং দলের জন্যও তা স্বস্তির কারণ হতে পারে।
প্রসঙ্গত আরেকটি কথা বলি, বিগত জোট সরকারের দুর্নীতির বিষয়টি তো ছিল তখন মানুষের মুখে মুখে। দুই শাসন এবং দুর্নীতি প্রসঙ্গে 'তারেক-মামুন' এ দুটো নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হতো। কোকোর প্রসঙ্গ এসেছে পরে, বিশেষ করে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এর আগে চারদলীয় জোটের, বিশেষ করে বিএনপির শাসন নিয়ে দুটো বিষয়ে 'মিথ' তৈরি হয়েছিল জনসাধারণের মুখে মুখে। প্রথমত, দুর্নীতি, দ্বিতীয়ত জঙ্গিবাদ তোষণ।
যে বিষয়টা একসময় শিক্ষিত শ্রেণীর ড্রয়িংরুমে এবং জনসাধারণের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল, ঘটনাক্রমে বিগত সরকারের সেই ব্যাপক দুর্নীতির কথা ফাঁস করে উইকিলিকস ঝড় তুলেছে সংবাদপত্র ও পাঠকমহলে। সেই তারেক-মামুন, সেই হাওয়া ভবনের কর্তৃত্ব সবই উঠে এসেছে সেই বার্তায়। অর্থাৎ মানুষ কাগজপত্রের প্রমাণ ছাড়াই যা ভেবেছে, বলাবলি করেছে তার প্রমাণ মিলেছে উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যে। বাদ যায়নি মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের মন্তব্যও। মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা তো তৃতীয় বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর হাঁড়ির খবর জোগাড় করে ওয়াশিংটনে পাঠান, কখনো মন্তব্যহীন, কখনো মন্তব্যসহ। এর ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। তবে এ ধরনের রাষ্ট্রদূতীয় আচরণ কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত কি না তা আমার জানা নেই। তবে এটা ঠিক যে এর ফলে দীর্ঘকাল পরে হলেও কিছু সত্য বেরিয়ে আসে। উইকিলিকস তো এক বিস্ফোরণ ঘটানো সংস্থা, যে জন্য যে কথা অনেক পরে জানা যেত তা আমরা তাৎক্ষণিক জানতে পেরেছি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আহ্বান থাকবে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি যাতে তাঁর ওই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি নিশ্চিত হয়ে নেন যে কথিত অভিযোগগুলো সত্য কি না। তাঁর এ আড়াই বছরের যেসব ইতিবাচক অর্জন তা নিয়ে কেউ কথা বলবে না (এক বিরোধী দল ছাড়া), কিন্তু প্রত্যাশিত অর্জন নিয়ে মানুষের অভিযোগ তো থাকবেই। যেমন_প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের হঠাৎ বেড়ে যাওয়া দাম। রোজার আগে থেকে হঠাৎ করেই জিনিসপত্রের দাম যেন আকাশ ছুঁতে থাকল। এখন তা কমে এলেও প্রাক-রমজান পর্যায়ে যায়নি। ব্যবসায়ীদের এই সীমাহীন লোভের ব্যাপারে কি কিছু করা যায় না? সাধারণ মানুষের জন্য কিছুটা স্বস্তির ব্যবস্থা করা যায় না? বিষয়টা ধনীদের জন্য সমস্যা নয়, প্রচণ্ড সমস্যা মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে সাধারণ মানুষের জন্য, যাদের আয় সীমাহীন নয়। বিষয়টা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ভেবে দেখতে বলি।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.