নিরাপত্তায় নেই আস্থা-রম্য by সাইফুল আলম

বললাম, 'শুধু জীবনের নিরাপত্তাই আমরা হারাচ্ছি না, সামাজিক, আর্থিক এমনকি অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর ঘরে স্ত্রীর নিরাপত্তা পর্যন্ত ঝুঁকির মুখে পড়ছে।' আমার কথাগুলো শেষ হতেই কিসমিস খোলা আকাশের দিকে এমনভাবে দৃষ্টি ফেলে তাকাল যেন অনেক দিন চক্ষু মেলে কিছু দেখে নাই ক'টা দিন ধরে কিসমিস আলীর মেজাজটা যেন বিগড়ে আছে। তার মুখমণ্ডলের মানচিত্রটায় যেন নিম্নচাপের দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত।
হ্যাঁ, আমি আমার অকৃত্রিম বন্ধু কিসমিস আলীর কথাই বলছি। হেতুটা সুধাতেই তার পুরু ভ্রু দু'জোড়ার মাঝখানের উপত্যকাটা যেন পৌনে এক মিলিমিটার গভীরে গিয়ে কুঁচকে গেল। মুখে কিছু না বলে সে আমার পানে বিরক্তির দৃষ্টি বোমা ছুড়ে দিল। আমি একটু ইতস্তত বোধ করে নীরবতার সঙ্গে সহবাস করতে লাগলাম। আমাকে মোহভঙ্গ করে সে এবার বলল, 'আচ্ছা দিনে দিনে আমরা একি পাচ্ছি বলতে পার?' আমি ওর চাওয়া-পাওয়া মাখা প্রশ্নটার উত্তরে বললাম, 'কেন, এ বয়সে আবার কী পেতে চাও দোস্ত? জীবন তো অস্তাচলের সূর্যের মতো বুড়িয়ে গেছে।'
'তোমার হা-হুতাশার রাগিণীটা আজও থামল না দোস্ত। আশা ভঙ্গ জীবনটাকে যে অকালেই থেঁতলে দেয়, তা কি বোঝ?' আমি তার কথায় শরম পেয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, 'তা আসল কথাটা বলেই ফেল না দোস্ত।'
'নিরাপত্তা!' কিসমিসের ইঙ্গিত ভরা উত্তর।
'নিরাপত্তা! খোলাসা করে ব্যাখ্যা করো দোস্ত', আমি আগ্রহ সহকারে জানতে চাইলাম।
'হ্যাঁ, জীবনের নিরাপত্তা, আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, রাস্তায় চলাচলের নিরাপত্তা_ এসব কি আজ কর্পূরের মতো উবে গিয়ে ইথারের গর্ভে ডুব দিল?'_ কথাগুলো এক দমের ওপর ভর করে যেন উদ্গিরণ করল কিসমিস। আমি বিস্ময়ের বেড়াজালে বন্দি হয়ে ওর পানে চেয়ে রইলাম। ভাবলাম, সত্যি এ শীর্ণকায় মানুষটির হাড্ডিসার বুকের খাঁচায় সামাজিক মূল্যবোধ কতটা গভীরে। তাই ওকে সমর্থনের ভালোবাসায় বললাম, 'তুমি কথাটা যথার্থই বলেছ দোস্ত। নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে বসে পুরো জাতি যেন প্রমাদ গুনছে।
'হ্যাঁ, দিন দিন সমস্যাটা যেন প্রকট হচ্ছে।'
'আমাদের গণমাধ্যমে অবশ্য সমস্যাটাকে নানা অঙ্গে নিত্যই তুলে ধরা হচ্ছে।'
'হ্যাঁ, আজকাল সকালের পত্রিকায় চোখ মেলার আগেই যেন অজানা আশঙ্কায় গা'টা শিউরে ওঠে।'
'এ নিয়ে আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকরাও তো নানা রচনা আর রঙ্গমঞ্চে প্রতীকী ঘটনা তুলে ধরছেন।'
'হ্যাঁ, আমরাও অতি উৎসাহে সেসব অবলোকন করে পারলে চেয়ারের ওপরে উঠে হাততালির প্রতিযোগিতায় নামছি। অথচ বাস্তবে ফলাফল যেন নাকের ডগায় কাঁচকলা।' কথাগুলো বলে কিসমিস তার বয়স্ক ঠোঁট দুটিকে যেন আকাশে সদ্য উদীয়মান একফালি চন্দ্রের মতো রূপ দিল। সেদিকে দৃষ্টি ফেলে আমার পানসে মনটাও যেন পৌষ মাসের খেজুর রসের মতো মিষ্টি হয়ে গেল। কিন্তু তা আর কতক্ষণ। সাম্প্রতিক জীবনযাত্রার বাস্তবতায় তা আবার তিক্ততায় রূপ নিল।
কিসমিসের জিগাতলার বাড়ির ছাদে এক অলস বিকেলে আমরা দু'বন্ধু আলাপের দরজাটা খুলে বসেছিলাম। বললাম, 'গুম-হত্যা, কুপিয়ে আহত, ছিনতাই, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণনাশ_ এসব যেন নিত্যকার সাথি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
'অথচ সংশিল্গষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজেদের সাফাই গাইতে গাইতেই অষ্টপ্রহর পার করছে।' কিসমিসের কণ্ঠে যেন হতাশা আর অবিশ্বাসের দাম্পত্য। বললাম, 'শুধু জীবনের নিরাপত্তাই আমরা হারাচ্ছি না, সামাজিক, আর্থিক এমনকি অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর ঘরে স্ত্রীর নিরাপত্তা পর্যন্ত ঝুঁকির মুখে পড়ছে।' আমার কথাগুলো শেষ হতেই কিসমিস খোলা আকাশের দিকে এমনভাবে দৃষ্টি ফেলে তাকাল যেন অনেক দিন চক্ষু মেলে কিছু দেখে নাই। আমি তার দিকে চেয়ে শুধালাম, 'দোস্ত, তা হঠাৎ খোলা আকাশে কী খুঁজছ?'
'খুঁজছি না_ ভাবছি'
'কী ভাবছ?'
'ভাবছি গণেশও আজকাল উল্টে যাচ্ছে।'
'সেটা কী?'
'কেন? সাম্প্রতিককালে খবরের কাগজে খবর পড় না?'
'তা তো পড়ি, কিন্তু তুমি কোন খবরটা ইঙ্গিত করছ?'
'স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমের বলি হয়েছেন বেচারা স্বামীটি।'
'তবে কি স্বামীরাও নিরাপত্তা হারাচ্ছেন!' আমি অবাক হয়ে বললাম।
'তবে আর কী। তা ছাড়া ইদানীং বেশকিছু তরুণী আর কিশোরী ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কি এভাবেই উধাও হলো?'
'এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৬০ শতাংশের বেশি পুরুষ নারীদের মানসিক অথবা শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন।'
'তা ছাড়া দেশের শিশুদের কথা ভাবলেও আতঙ্কিত হতে হয়। শিশু অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদা দাবি, শিশু বেচাকেনা_ এসব আজ সমাজকে কলুষিত করে ফেলেছে।'
'শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি শিশুখাদ্যে ভেজালের রহস্যকাণ্ড আবিষ্কৃত হয়ে গেছে, সুতরাং অবুঝ শিশু স্বাস্থ্যের নিরাপত্তায়ও ঘুণ ধরেছে।' আমার কথা শুনে কিসমিস হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে বলল, 'বাহ্ তুমি তো বেশ ভাবতে শিখেছ দোস্ত। সত্যি আমি পুলকিত হলাম।' ওর কথা শেষ হলে আমিও উঠে দাঁড়াতে উদ্যত হতেই ও আমাকে নিবৃত্ত করে তার চেয়ারটায় আরাম করে বসে বলল, 'দোস্ত আরেক কাপ চা চলবে নাকি?' আমি আপত্তি জানিয়ে বললাম, 'না দোস্ত খানিক আগেই তো চা নাশতার সদ্ব্যবহার করলাম। বরং এসো আমাদের আলাপটাকে আরও গিয়ার আপ করি।' ও এবার একটু নড়েচড়ে বসে বলল, 'শুধু শিশুখাদ্য কেন, আমাদের দেশের ফলমূল, শাকসবজি আর নানা খাদ্যের অঙ্গে অঙ্গে নানা দুশ্চরিত্রের ভেজালের অহরহ যে চুম্বন বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে খাদ্য নিরাপত্তাও যেন লজ্জায় অবগুণ্ঠনের মাঝে মুখ লুকাচ্ছে।' কিসমিসের রসাল সংলাপ রচনায় আমি যারপরনাই পুলকিত হয়ে বললাম, 'দোস্ত, সামাজিক সমস্যাগুলোকে তুমি যেন স্পঞ্জের রসগোল্লার রসেই পরিবেশন কর। অবশ্য সমাধানের দুয়ারটা খোলারও ভাবনা কর।'
'দোস্ত, সামাজিক সমস্যার সমাধান সমষ্টিগতভাবেই হয়। একক ভাবনা শুধু আঁস্তাকুড়েই আশ্রয় নেয়।' কথাগুলোয় কিসমিস যেন নিজেকেই ধিক্কার দিল। আমি এবার তাকে উদ্দীপনার আঁচে উত্তপ্ত করার প্রয়াসে বললাম, 'তা কেন দোস্ত, তোমার ভাবনা তো একসময় সমষ্টিগত চেষ্টায় রূপ নিতে পারে। তা যাক সে কথা, নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ, আজকাল অস্ত্র চালনা করে রাস্তাঘাটে টাকাপয়সা ছিনতাই বেশ প্রকোপ হয়েছে।'
'শুধু তা-ই নয়, বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিপদমুক্ত হয়ে যে আবার বাড়ি ফিরবে তারও নিশ্চয়তা নেই।' আমি এবার অসহায় কণ্ঠে বললাম, 'কিন্তু সব ক্ষেত্রেই এ অবক্ষয় কেন?' আমার প্রশ্নটা কিসমিসের বিবেকের পর্দায় যেন ঢিল ছুড়ে দিল। দু'দণ্ড চোখ মুদে সে যেন তার মনের সুইমিং পুলটায় সাঁতার কেটে উঠে এলো। তারপর সি্নগ্ধ কণ্ঠে বলল, 'আমাদের নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয়। একবার ভেবে দেখো, পৃথিবীতে যত উন্নত জাতি আছে তা তারা অর্জন করেছে সম্মিলিত চেষ্টায়। চাপাবাজি আর মিথ্যার বেসাতি সাজিয়ে কোনো জাতির নিরাপত্তা রক্ষা করা যায় না।' আমি কিসমিসের নিষ্ঠুর সত্য সংলাপটাকে হজম করতে করতে বললাম, 'দোস্ত, তুমি বড্ড গভীরে গা ডুবিয়ে দিয়েছ।'
'কী করব? বিবেককে তো আর বধ করতে পারি না।'
'কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার এ মহামারী নিয়ে তোমার ভাবনা শাস্ত্রে কি কিছু বলে?'
'আইনের সঠিক প্রতিষ্ঠা, খাঁটি অপরাধীদের বাপের নাম ভোলানো শাস্তি উপহার, আর মানবতা ও দায়িত্ববোধ এ রোগের মহাচিকিৎসা।'
'অথচ এসব যেন আমাদের কাছে আজ রূপকথার মতো।'
'হ্যাঁ, তুমি বাস্তব চিত্রটাতেই রঙ ঢেলেছ দোস্ত।' আমাদের আলোচনায় ব্যস্ত রেখে সন্ধ্যাটা কখন যেন চুপিসারে চারদিকটা ঢেকে ফেলেছিল। সেদিকে চোখ পড়তেই আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, 'দোস্ত, এবার তবে আসি। প্রার্থনা করো রাস্তায় পা চালিয়ে নির্বিঘ্নে যেন মাই সুইট হোমে পেঁৗছাতে পারি।'

ডা. সাইফুল আলম :ডেন্টাল সার্জন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

No comments

Powered by Blogger.