ইপুটভি থেকে কোপেনহেগেন by মুহম্মদ নূরুল হুদা

ইপুটভি কথাটির মানে আমার প্লানচেট বন্ধু লাকী ছাড়া দ্বিতীয় কারোর জানার কথা নয়। লাকীরও যে মনে আছে তা আমি হলফ করে বলতে পারব না। তাকে মোবাইল করলাম, কোনো উত্তর এলো না। অগত্যা ফোন করলাম জামালকে। জামাল একটি প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিকের কর্তাব্যক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ইংরেজি পড়তাম।

সে দিল মন্টুর নাম্বার। লাকীর নাম্বার পেলাম মন্টুর কাছে। মন্টু আর লাকী দুজনই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বছর দুয়েক আগে রিটায়ার করেছে। ওরা আমার কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। লাকীর আসল নাম জামশেদুজ্জামান, মন্টুর নাজমুল হাসান। দুজনই ঝানু অর্থনীতিবিদ। লাকী বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লেখালেখি করত প্রচুর। লিখত মূলত কিশোর গল্প, ছড়া, আর কখনও-সখনও বড়দের গল্প। ওর গদ্য যেমন ঝরঝরে, তেমনি ব্যঞ্জনাধর্মী। কেন যে সে লেখালেখিটা থামিয়ে দিল বোঝা মুশকিল। মাঝখানে কিছুটা ঝুঁকেছিল অতীন্দ্রিয় সাধনায়। ঝোঁকটা তার মধ্যে লক্ষ্য করেছি প্রথমাবধি। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তির পরপরই আমাদের প্লানচেট শুরু। সপ্তাহে দু’এক রাত কাটিয়ে দিতাম অদৃশ্য আত্মার সঙ্গে। নানান কালের নানান জাতের নানান মানুষের আত্মা হাজির করাটা ছিল আমাদের প্রিয় নেশা। জীবদ্দশায় ওরা মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা না জানলেও মৃত্যুর পর যে আত্মামানুষ ধরা দিত আমাদের ধ্যানে, তারা জানত সব ভাষা। আমাদের সঙ্গে বাংলা বা ইংরেজিতে কথা বলত অনর্গল। মনে হতো আত্মামানুষ মানে বিশ্বমানুষ, কালাতীত মানুষ, সব মানুষের কাছের মানুষ। রাত বারোটা থেকে ফজরের আজান পর্যন্ত সেই কালাতীত বন্ধুর খোঁজে বিনিদ্র কাটিয়েছি কত কত রাত। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তেমনি অনেক কালাতীত আত্মামানুষকে আমরা প্রশ্ন করেছি, জেনে নিতে চেয়েছি আমাদের ব্যক্তিক ও সামষ্টিক বর্তমান বা ভবিষ্যত্। আজ পেছন ফিরে দেখি, তারা যা বলেছে তার অনেক কিছুই সত্যের কাছাকাছি। তার নানা উত্তর থাকতে পারে মনস্তাত্ত্বিকের কাছে। আমি শুধু তাকে ব্যাখ্যাতীত রহস্য বলেই মেনেছি। তবে সব আত্মামানুষের মধ্যে বিশেষভাবে মনে পড়ে একজনের কথা। তার নাম টোগো। আমরা প্লানচেটের জপমন্ত্র পড়ে মাধ্যম-মুদ্রাটা চেপে ধরলেই সে হাজির হতো আমাদের কাছে। মাঝে মাঝে তাকে অনুরোধ করে বিদায় দিতাম, সন্ধান করতাম অন্য আত্মামানুষের। তাতে টোগোর মনটা খারাপ হয়ে যেত। আমাদের ভালোবেসে ফেলেছিল টোগো। জানতে চাইতাম, তুমি কোন দেশের নাগরিক। সে তার দেশের নাম বলত, ইপুটভি। আমরা হাসতাম অবিশ্বাসের হাসি। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশের নাম তো আমাদের জানা নেই। টোগো বলত, হে পুঁচকে ছোকরার দল, কিইবা তোমাদের বয়স, কিইবা তোমাদের জ্ঞানগম্মি। তোমরা কি আটলান্টিক মহাসাগরের নাম শোননি? আমরা বলতাম, আলবত্ শুনেছি। ‘সেই মহাসাগরের নিচে তলিয়ে যাওয়া এক বিশাল ভূখণ্ডের নাম আটলান্টিস, তা কি তোমাদের জানা নেই?’ আমরা আমতা আমতা করতাম, হ্যাঁ, সেরকম একটা কিছু পড়েছি বইপত্রে, তবে ভূখণ্ডটা নিজ চোখে দেখিনি। টোগো হাসত, বলত—তোমাদের সেই না-দেখা মহাভূখণ্ডেরই একটি দেশের নাম ইপুটভি। বিশ্বাস করা না করা তোমাদের ব্যাপার। আমরা বলতাম, আটলান্টিস যে তলিয়ে গেছে তাতে আমাদের অবিশ্বাস নেই। কিন্তু কেন তলিয়ে গেছে তা তো জানি না। টোগো বলত, সে তো তোমাদের ইতিহাস-পূর্ব যুগের কথা, জানবে কী করে? তবে মনে রেখ, আমাদেরই কর্মফলে আজ আমাদের এই দশা। আমাদের অপরিণামদর্শিতার ফলেই ঘটে গেছে আমাদের সলিলসমাধি। হেঁয়ালির মতো ঠেকত কথাটা। আমরা তার কাছে আমাদের ভবিষ্যত্ জীবনের আরও কিছু বাস্তব সত্য জানতে চাইলাম। কিছু কিছু বলল, কিছু কিছু বিষয়ে নীরব রইল। কবুল করতে দ্বিধা নেই, আমার পারিবারিক ও কর্মজীবন সম্পর্কে টোগো যা কিছু বলেছিল তার অধিকাংশই ফলে গেছে। তবু তার সব কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারিনি। বারবার মনে হতো, হয়তো সবটাই কাকতালীয়। তেমনি কাকতালীয় আরেকটি বৈশ্বিক ঘটনার কথা ভেবে অবাক হচ্ছি এই ষাটোত্তর বয়সেও। পরিবেশের উষ্ণতা নাকি মাত্র দুই শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেতে থাকলেই অদূর ভবিষ্যতে আমাদের চোখের সামনে তলিয়ে যেতে পারে ভারত মহাসাগরে এক দ্বীপরাষ্ট্র ‘মালদ্বীপ’, তলিয়ে যেতে পারে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এক বিশাল অঞ্চলসহ বিশ্বের অনেক দেশ। অর্থাত্ ওরা সবাই আমাদের প্লানচেট বন্ধু টোগোর দেশ ইপুটভি’র ভাগ্যবরণ করবে। টোগোর দেশ তলিয়ে গিয়েছিল তাদের কর্মফলজাত মহাপ্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, আর একালের তৃতীয় বিশ্বের বিপন্ন দেশগুলোও তলিয়ে যাবে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের কারণে। এই বিপর্যয়ের উত্স ধনী ও উন্নত দেশগুলোর গ্রিন হাউস ইফেক্ট, তথা জীবাশ্ম কার্বন নিঃসরণ, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। এর সমাধান করা অত্যাবশ্যক ভেবে যুক্তরাষ্ট্রের মহাক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট থেকে তৃতীয় বিশ্বের ঢালতলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার পর্যন্ত প্রায় সব রাষ্ট্রপ্রধান বৈঠক করছেন কোপেনহেগেনে। সবাই একমত যে একটা কিছু করা দরকার, নিদেনপক্ষে অঙ্গীকার; কিন্তু বিপন্ন রাষ্ট্রগুলোর জন্য কার্যকর কোনো চুক্তি স্বাক্ষরে প্রচণ্ড অনীহা মহাগদাধর বিশ্বনিয়ন্ত্রক যুক্তরাষ্ট্র থেকে জায়মান সমাজতান্ত্রিক বিশ্বশক্তি চীন পর্যন্ত। বোঝা যাচ্ছে, প্রথম ও দ্বিতীয বিশ্বের শক্তিধরের স্বার্থের কাছে মার খাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের নিরীহ ও নিরস্ত্র মানবতা, কোপেনহেগেনে জগতমানুষের সদাচারী বিবেক সলিলসমাধি বরণ করছে টোগোর দেশ ইপুটভির মতো। ভাবছি আবার প্লানচেট করব, অন্তত আত্মামানুষ টোগোর কাছেই জানতে চাইব কবে পৃথিবীর তিন ভাগ জল পুরোপুরি গ্রাস করবে এক ভাগ স্থলকে।
লেখক : কবি, প্রফেসর, কলামিস্ট; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব

No comments

Powered by Blogger.