গোলাপ কিংবা জারুল ঝেড়ে ফেলে by জামান সরদার

শেষ পর্যন্ত মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যমে সু চির নাম ছাপার অক্ষরে দেখা গেছে। কেবল নাম নয়, তার নিজের লেখা কলাম। গত জুলাই মাসে ধর্মীয় পর্যটন শহর পাগান ভ্রমণে যেতে যেতে তিনি কী দৃশ্য দেখেছিলেন, মনে কী ভাবের উদয় হয়েছিল তারই বৃত্তান্ত। দেখা গেছে ছবিও। 'পিইথু খিত' (বাংলায় বলা যেতে পারে 'জনযুগ') সংবাদ-সাপ্তাহিকের প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছে ওই কলাম। সঙ্গে ছবি_ সবুজ ঘাসে বসা হাস্যোজ্জ্বল সু চি।


পাশে দাঁড়ানো পুত্র তাইন লিন, কাছে ঘুরঘুর করছে প্রিয় কুকুর। লেখাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল জাপানের মিনিচি শিম্বুন পত্রিকায়। ওই পত্রিকায় তিনি ১৯৯৫ থেকে তিন বছর 'লেটার ফ্রম বার্মা' কলাম লিখতেন। পরে গৃহবন্দি হন। এ বছর জানুয়ারিতে বন্দিদশা ঘোচার পর ফের লেখা শুরু করেন।
সন্দেহ নেই, সু চি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বহুল আলোচিত নাম। কিন্তু গত ২৩ বছর দেশের অভ্যন্তরে তার নাম ছাপা বা উচ্চারিত হতে পারত না। মিয়ানমারের এক সাংবাদিক ঢাকা সফরে এসে বলেছিলেন সেখানে ব্যক্তি উদ্যোগে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ কেন অসম্ভব। সাপ্তাহিক পত্রিকা মেকআপ শেষ করার পর সেন্সর বোর্ডে জমা দিতে হয়। ছাড়পত্র পেলেই তবে ছাপার কাজ শুরু। কড়া নজরদারি এড়িয়ে সু চির নাম ছাপা অসম্ভব।
অথচ তিনি, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম যেমনটি বলে থাকে_ মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী। অবশ্য বার্মিজ জনগোষ্ঠীর কাছে অং সান সু চি তার থেকেও বেশি কিছু। হতে পারে ১৯৮৮ সালের প্রথম দিককার এক সন্ধ্যায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স কোয়ার্টার ছেড়ে যখন রেঙ্গুনের ইনিয়া ঝিলপাড়ের নিঃসঙ্গ বাড়িটিতে উঠেছিলেন, তখন অসুস্থ মায়ের পাশাপাশি আহত মাতৃভূমির দেখাশোনার তাগিদও তার মনে ছিল। বার্মিজ সংস্কৃতিতে শুভ বিবেচিত অষ্ট চতুষ্টয়ে_ '৮৮ সালের অষ্টম মাসের আট তারিখ_ রেঙ্গুনের বৌদ্ধ স্বর্ণমন্দির চত্বরের জনাকীর্ণ জমায়েতে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার অভিষেকও ঘটেছিল। কিন্তু গত দুই দশকে নিছক নেতা নন, তিনি পরিণত হয়েছেন গণতন্ত্রের প্রতীকে। ২১ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ১৫ বছরই গৃহবন্দি কিংবা বন্দি থেকেও পেঁৗছে গেছেন ঘরে ঘরে। দেশের বেশিরভাগ মানুষই তাকে স্বচক্ষে দেখেনি; কিন্তু তিনি তাদের একান্ত আপনজন। সামরিক জান্তা তাকে যত দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছে মানুষ তাকে তত কাছে টেনেছে। সামরিক জান্তা সু চির নাম উচ্চারণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তাতে কি? মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ তাকে ফুপি, এমনকি মা বলে সম্বোধন করে।
সামরিক সমন এড়াতে সাধারণ মানুষ না হয় মনের মাধুরী মেশাতে পারে; সংবাদমাধ্যম কী করেছে? সাংবাদিকদের পারস্পরিক আলোচনায় তাকে উল্লেখ করা হতো 'দ্য লেডি' কিংবা 'গোলাপ' হিসেবে। গোলাপ কেন?
সামরিক জান্তা যখন অং সাং সু চিকে ইনিয়া লেকপাড়ের বাড়িটির বাইরের মিয়ানমার থেকে মুছে ফেলার আয়োজনে গলদঘর্ম, বাঙালি পাঠক জেনে আনন্দিত হবেন, তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতেন। নিঃসঙ্গ লাগলে যোগব্যায়াম করতেন। সঙ্গে মৃদুশব্দে রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর পছন্দ করতেন সাজতে। বিশেষ করে খোঁপায় জারুল ফুল গুঁজতে। অং সান সু চির যেসব ছবি সচরাচর পাওয়া যায়, তার অনেকগুলোই বেগুনি আভায় উজ্জ্বল। সরাসরি জারুলের কথা বললে যদি সরকারের কোপানলে পড়তে হয়, তাই গোলাপের আশ্রয় নেওয়া।
মিয়ানমারের আধা-সামরিক সরকারের সঙ্গে সু চির যে সম্পর্কোন্নয়ন হচ্ছে, এই লেখা ও ছবি সেন্সর বোর্ডে ছাড়া পাওয়ার ঘটনা তারই প্রমাণ। জারুল কিংবা গোলাপ ঝেড়ে ফেলে অং সান সু চি অচিরেই নিজ নামে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত হাজির হবেন, সীমান্তের এপাশ থেকে সে আশা আমরা করতেই পারি।
 

No comments

Powered by Blogger.