অর্থনীতি-রাজস্বনীতিতে হ-য-ব-র-ল by আসজাদুল কিবরিয়া

অর্থনীতি নানামুখী চাপের মুখে পড়েছে। এই চাপ সামাল দিতে সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে; বিশেষ করে, সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার রাজস্বনীতি পরিচালনায় অপরিণামদর্শিতা ও বিশৃঙ্খলার চিত্রটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাজস্বনীতিকে কোন দিকে বা কীভাবে পরিচালনা করা হবে, তা যেন নীতিনির্ধারকেরা ঠাওর করতে পারছেন না। কখনো রাজস্ব কৃচ্ছ্র, কখনো রাজস্ব ছাড় আবার কখনো রাজস্ব সুসংহতকরণের চেষ্টা—এ রকম করে রাজস্বনীতিতে জট পাকিয়ে ফেলা হচ্ছে।


সেপ্টেম্বর মাসেই সরকার বিভিন্ন ধরনের—পাঁচ ধরনের জ্বালানি তেলের দর বাড়িয়েছে। ফার্নেস তেল প্রতি লিটার আট টাকা বাড়িয়ে ৫০ টাকা করা হয়েছে। বাকি চারটির (পেট্রল, অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিন) দর প্রতি লিটার পাঁচ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে সিএনজির দরও। এর পেছনে যুক্তি হলো, ভর্তুকির বোঝা কমানো।
জ্বালানি তেল আমদানিতে ভর্তুকির বিষয়টি নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরে এই প্রবণতা চলে আসছে। এটি অর্থনীতি, বিশেষ করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার কোনো প্রতিফলন নয়, হতে পারে না। সে জন্যই ভর্তুকি কমানোর পদক্ষেপটি সামনে চলে আসে। আর তা করতে গেলে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ পর্যন্ত যুক্তির ধারা ঠিক, তবে পরিপূর্ণ নয়; বরংকিছু বিভ্রান্তি ও অস্বচ্ছতা কাজ করছে। প্রথমত, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াই আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ নয়। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম গত এক বছরে ওঠানামার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়েছে। ভবিষ্যতেও তা-ই হবে। তবে মোটের ওপর দাম যে বাড়ছে, তা সত্যি। তাই আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। এর বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকার যে অনুমতি দিয়েছে, সে জন্য তেলের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পরিমাণ বৃদ্ধি যুক্ত হয়ে মোট ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত, জ্বালানি তেল আমদানি বাড়ার সঙ্গে সরকারের আমদানি শুল্কপ্রাপ্তিও বেড়েছে। কেননা, জ্বালানি তেল আমদানির জন্য প্রতি লিটারে গড়ে সাত টাকা হারে শুল্ক দিতে হয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি)। এই শুল্ক বাবদ অর্থ পুরোটাই তো যায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। তেল আমদানি যত বাড়ে, এই শুল্কের পরিমাণ তত বাড়ে। শুল্কের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে উচ্চ হারে ভর্তুকি দেওয়ার যুক্তি খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। আবার বিপিসিকে কম সুদে সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ দেওয়া হয়। যেহেতু ঋণ, সেহেতু তা পরিশোধযোগ্য। সরকার সরাসরি কিছু তহবিলও দেয় বিপিসিকে। তাই তেল আমদানির ভর্তুকির হিসাবটি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এটা সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতারই প্রতিফলন।
দেশে মূল্যস্ফীতির হার ক্রমেই বাড়ছে। সেপ্টেম্বর মাসে এই হার স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি প্রশমনে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতি পরিচালনা করে চলেছে। বাড়ানো হয়েছে নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন সুদের হার, যেন বাজারে অর্থপ্রবাহে রাশ টানা যায়। এটা ঠিক যে সাম্প্রতিক কালে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ অনেক বেড়ে গেছে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে ভূমিকা রাখছে। তবে মুদ্রানীতি প্রয়োগ করে একটা পর্যায়ের পর আর মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়; বরং প্রয়োজন রাজস্বনীতির অর্থবহ প্রয়োগ। তার কোনো প্রয়াস দেখা যাচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে না রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সুসমন্বয়।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় ভর্তুকি কমানোর তথা রাজস্ব কৃচ্ছ্রের যুক্তিতে সরকার যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াল, তা অনিবার্যভাবে মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে। এর মধ্যে পরিবহন ব্যয় বেড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়েছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া তো নির্বিচারে বেড়েছে। পরিবহনের ভাড়ার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। বর্ধিত পরিবহন ব্যয় নিত্যপণ্যের দামের ওপরও প্রভাব ফেলছে। দুই ক্ষেত্রেই সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষকে মূল্য গুনতে হচ্ছে। তার প্রকৃত আয় অনেক কমে যাচ্ছে, কমছে ক্রয়ক্ষমতা। এভাবে একদিকে সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে আবার সেই মূল্যস্ফীতিকেই উসকে দিচ্ছে।
বলা যায়, মূল্যস্ফীতি প্রশমনে রাজস্বনীতির কোনো হাতিয়ার ব্যবহারে সরকারের আগ্রহ বা চেষ্টা নেই। অর্থনীতির পরিভাষায় মূল্যস্ফীতি হলো বেশি পরিমাণ অর্থ অল্প পরিমাণ পণ্যের পেছনে ছুটছে। মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া বশে আনতে যাওয়ার মানে হলো, বেশি অর্থ হাতে পেয়ে যে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে, তা কমিয়ে আনা। সে জন্য অর্থপ্রাপ্তিকে ব্যয়বহুল করে তুলতে হবে, যা সাধারণত সুদের হার বাড়িয়ে করা হয়। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, যার যত বেশি আয়-উপার্জন, তার অর্থপ্রাপ্তির সুযোগও তত বেশি, ব্যয়ের সুযোগও বেশি। আর তাই উচ্চ আয়ের ওপর বর্ধিত হারে করারোপ হতে পারে মূল্যস্ফীতি প্রশমনের অন্যতম উপায়।
বাংলাদেশে এ বিষয়টা এখন গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা দরকার। আর্থসামাজিক আয়বৈষম্য প্রকটতর হওয়ায় অল্প মানুষের হাতে অনেক বেশি অর্থ-সম্পদ চলে গেছে। তারা তা ভোগবিলাসে ব্যয় করছে। সে তুলনায় তারা আয়কর দিচ্ছে অনেক কম। অর্থনীতিতে যে কালোটাকার বিস্তার, তা-ই প্রমাণ করে যে বিপুল পরিমাণ আয়-উপার্জন করের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। অথচ রাজস্বনীতিতে এদিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা তেমন দেখা যাচ্ছে না। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবটিও স্পষ্ট।
আবার সরকার যুক্তিবুদ্ধিহীনভাবে বিভিন্ন ধরনের রাজস্ব ছাড় দিয়েছে। বেতনভোগী মানুষ বছরে তিন-চার লাখ টাকা আয় করে ২০-২৫ হাজার টাকা আয়কর দেন। শেয়ারবাজারে ৮-১০ লাখ টাকা মূলধনি মুনাফা করেও তার ওপর একটি টাকা আয়কর দিতে হয় না। এই অন্যায্য কর ছাড় ইতিমধ্যেই রাজস্ব তথা কর-ব্যবস্থাপনার নৈতিক ভিত্তিকে অনেক দুর্বল করে ফেলেছে। অতিসম্প্রতি শেয়ারবাজারে প্রণোদনা দেওয়ার নামে একাধিক কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, যা চরম আস্থাহীন এই বাজারে তেমন একটা কাজে আসবে না। মাঝখান থেকে রাজস্ব খাতের বিশৃঙ্খলাই উৎসাহিত হয়েছে।
কর প্রশাসনের দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। কীভাবে গৃহস্থালি ব্যবহারযোগ্য একটি ইলেকট্রনিক সামগ্রীর আমদানি মূল্য একই সামগ্রীর একটি যন্ত্রাংশের আমদানি মূল্যের চেয়ে কম হতে পারে? অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে এমন কাণ্ড তো ঘটে চলেছে। কর ফাঁকি রোধে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ তথা সরকার এদিকে তেমন নজর দিতে আগ্রহী নয়।
বরং সরকার রাজস্ব কৃচ্ছ্রের কথা ভাবছে। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে রাজস্ব কৃচ্ছ্র সুফল বয়ে আনবে না। রাজস্ব কৃচ্ছ্র মানেই হলো বাজেট ঘাটতি কমানো। আর তা কমানোর সহজ উপায় হলো সামাজিক খাতে ব্যয় কর্তন ও ভর্তুকি হ্রাস। ইতিমধ্যেই জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য আরেক দফা বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ পেতে সরকারকে এভাবেই রাজস্ব কৃচ্ছ্র করতে হবে, যা রাজস্বনীতির বিশৃঙ্খলা বাড়াবে বৈ কমাবে না।
আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.