সাহিত্যের শিক্ষক by ময়ূখ চৌধুরী

১. এ বছরের গোড়ার দিকে লিটল ম্যাগাজিনের এক সম্পাদক আমার কাছ থেকে সাক্ষাৎকারমূলক কিছু কথা জানতে চেয়েছিলেন। এর মধ্যে 'বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী' আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রসঙ্গও ছিল। আমি তাঁর স্নেহভাজন ছাত্র ছিলাম_এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে সম্পাদক মহোদয় তাঁর সম্পর্কে আমাকে কিছু বলতে অনুরোধ জানান।


ভাবতে ভালো লাগছে, হেনা স্যারের মৃত্যুর ২২ বছর পরও এখনো কেউ কেউ আছেন_যাঁরা তাঁর সম্পর্কে দু-একটা কথা শুনতে চান। আমার বোধ এবং বিশ্বাস অনুযায়ী সম্পাদককে আমি তিনটি কথা বলেছিলাম।
এক. প্রশংসাধন্য ব্যক্তির সংখ্যা আমাদের সমাজে নেহাত কম নয়, কিন্তু 'ঈর্ষাধন্য' ব্যক্তিত্ব বলতে আমি তাঁকেই বুঝি। দুই. সাহিত্যের ছাত্র হয়েও আবু হেনা মোস্তফা কামালের ছাত্র হতে না পারা জীবনের চরম ক্ষতিগুলোর মধ্যে একটা। তিন. মাথানত করে দাঁড়ানোর মধ্যেও যে গৌরব আছে, সেটা আবু হেনা মোস্তফা কামালের সামনে গিয়েই প্রথম বুঝেছি_এই তিনটি কথা একত্রে আর কারো সম্পর্কেই প্রযোজ্য নয়।
২. এখন প্রশ্ন : কেন এই ঈর্ষা? তিনি তো বিস্তর জমিজমা কিংবা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক ছিলেন না! মৃত্যুর সময় তাঁর ব্যাংক-ব্যালান্স ছিল চার হাজার ৫০০ টাকার মতো। এই অঙ্কের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কত বুদ্ধিমান! ছাত্রজীবনের গণিতশাস্ত্রে তিনি কাঁচা ছিলেন না। অথচ অন্য অনেকের মতো, উত্তরমালা দেখে দেখে জীবনের অঙ্কগুলোর সফল সমাধান তিনি করে যাননি। তাঁর স্বভাব বলে, তিনি তা চানওনি।
৩. আবু হেনা মোস্তফা কামাল জীবনকে ভালোবাসতেন, জীবনের ব্যাকরণকে নয়। বাংলাবাজারের উপযোগী ব্যাকরণ বই অনায়াসে তিনি লিখতে পারতেন; তবু লেখেননি। তাতে কিছু বাড়তি উপার্জন হতেও পারত। তিনি হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন_এই জাতীয় কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে 'পণ্ডিত' আখ্যা হয়তো পাওয়া যায়; কিন্তু শিল্পী হওয়া যায় না। হয়তো তিনি মনে করেছিলেন, জীবনটাই এক শিল্প_বিস্ময়কর আনন্দ-বেদনার মধ্য দিয়ে তা রচিত হয়।
'অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়_/আরও এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/খেলা করে;'_এই উপলব্ধি 'মহাপৃথিবী'র অধিবাসী জীবনানন্দদাশের। এই পঙ্ক্তি অনেকেরই ভালো লেগেছে, কিন্তু সেই ভালোলাগাটুকুকে ভালোবাসার মতো অন্তর্গত রক্তের ভিতরে মিশিয়ে দিতে পারেননি অন্যেরা। কিন্তু আবু হেনা মোস্তফা কামাল তা পেরেছিলেন। এই সাফল্য প্রমাণ করে, স্বার্থচিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর দূরদর্শিতার অভাব ছিল।
তাঁকে ঈর্ষা করার কারণ শুধু এই? উত্তর : না। কারণ আরো আছে, বহু রকমের কারণ।
৪. তাঁর সম্পর্কে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে তিনি ভর্তি হন ১৯৫৪ সালে, আমার এক বছর পরে। তখনো পর্যন্ত তাঁর মতো মেধাবী ছাত্র এ বিভাগে ভর্তি হয়নি, তার পরেও হয়েছে কি না সন্দেহ। ম্যাট্রিক-ইন্টারমিডিয়েটে মেধা তালিকায় স্থান পেয়ে বাংলা পড়তে এসেছে, এমনটি ঘটত না। কিন্তু আবু হেনার মেধা শুধু তালিকায় স্থান পাওয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল না। অসম্ভব শ্রুতিধর ছিলেন তিনি, যা একবার পড়লেন বা শুনলেন, তা অবলীলায় মনে রাখতে পারতেন।
ছাত্র হিসেবে আবু হেনা ত্রুটিমুক্ত ছিলেন না। বন্ধুবাৎসল্য কিংবা অভ্যস্ত রুচিবশত আনিসুজ্জামান সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন। (এটাও প্রশংসনীয় ব্যাপার বৈকি)। প্রতিটি ক্লাসে উপস্থিত থেকে 'ইয়েস স্যার' বলার মতো ছাত্র ছিলেন না আবু হেনা। যে ক্লাস ভালো লাগত না, সেই ক্লাস তিনি করতেন না। সোজা কথায়, ছাত্রসুলভ নিয়মানুবর্তিতা তিনি লঙ্ঘন করেছিলেন।
তিনি মেতে থাকতেন গানবাজনা আর কবিতা নিয়ে। সংস্কৃতিজগতে বিরামহীন আড্ডায় মেতে থাকতে ভালোবাসতেন। প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মশৃঙ্খলার প্রতি আনুগত্য ছিল না বললেই চলে। সাব্যস্ত হলো : যেহেতু তাঁর প্রয়োজনীয়সংখ্যক উপস্থিতি নেই, সেহেতু তিনি পরীক্ষা দিতে পারবেন না। পরে আহমদ শরীফ ও মুনীর চৌধুরীর প্রবল বিরোধিতার মুখে ওই সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হয়েছিল। যথাসময়ে কয়েকজন শিক্ষকের ধারণাকে অমূলক প্রমাণ করলেন তিনি। ব্যাপক ব্যবধান রেখে পর পর দুটি পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।
তার পরও তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, রাজধানী থেকে অনেক দূরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক স্যাঁতসেঁতে কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে হয়েছিল! এতেই বোঝা যায়, ক্যারিয়ার তৈরির প্রচলিত কৌশলে তিনি দীক্ষিত হননি। দরিদ্র স্কুলশিক্ষকের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও গাণিতিক বিষয়বুদ্ধির পরিচয় তিনি দিতে পারেননি।
৫. শিল্প-সাহিত্যের প্রতি সহজাত অনুরাগবশত তিনি যেখানেই গানবাজনা-কবিতার প্রাধান্য দেখেছেন, সেই পরিবেশে তিনি ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছেন। সেক্ষেত্রে বিভেদক লক্ষণকে (Differentia) তিনি আমলে আনেননি। ফলে তাঁকে ভুল বোঝার মতো অবকাশও সৃষ্টি হয়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, 'তখন তিনি যাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন, তাদের আমরা দক্ষিণপন্থী বলে বিবেচনা করতাম।'_[পূর্বোক্ত]। 'আমরা' বলতে তিনি উল্লেখ করেছেন নিজেকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের অন্যতম নেত্রী সাবেরা খাতুনকে (আবু হেনা মোস্তফা কামালের বড় বোন)। 'আর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, হাসনাত আবদুল হাই, মোস্তফা জামান আব্বাসীর সঙ্গে মিলে আবু হেনা গড়ে তোলেন প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন শিল্প ও সাহিত্য পরিষদ।'_[পূর্বোক্ত]।
এ ক্ষেত্রে বিরোধ নয়, পার্থক্যটুকুই দেখার বিষয়। সংস্কৃতি সংসদের কার্যক্রমে রাজনীতির প্রাধান্য ছিল বেশি, শিল্প-সাহিত্য ছিল গৌণ উপকরণ মাত্র। পক্ষান্তরে, নামকরণের মধ্যেই শিল্প ও সাহিত্য পরিষদের আগ্রহ ও রসানুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়। অতএব এই ভিন্নতাকে রুচিগত ব্যাপার হিসেবে দেখাটাই ভালো ছিল। আর যদি রাজনৈতিকভাবেই দেখা হয়, তাহলে তো উলি্লখিত সাতজনের কাউকেও 'বামপন্থী' বলা যাবে না_অন্তত বদরুদ্দীন উমর, আহমদ শরীফ, মুনীর চৌধুরী ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর তুলনায়। অতএব, বিষয় যেখানে সাহিত্য, সেখানে_কে সংস্কৃতি সংসদ করতেন, কে সাহিত্য পরিষদ করতেন, কে মুসলিম চিন্তাধারাকে গবেষণার বিষয় করলেন, আর কে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে গবেষণার বিষয় করলেন_এ সব নিয়ে কথা বাড়ানোর প্রয়োজন দেখি না। তা ছাড়া প্রকৃত সাহিত্যপ্রেমিক ডানে-বামে না-ও তাকাতে পারেন।
প্রতিভার প্রবণতা অনুযায়ী যে যার আগ্রহ নিয়ে মেতে থাকতে চায়_এটাই স্বাভাবিক। একই সিরাজদ্দৌলাকে বিষয় করে কেউ হন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, কেউ হন শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত;_প্রথমজন লিখলেন ইতিহাস, দ্বিতীয়জন রচনা করলেন সাহিত্য। দুজনই যে যার উদ্দেশ্যে সফল।
এখন প্রশ্ন হলো : একজন সাহিত্যপ্রেমিক কোন বইটি আগে হাতে নেবেন? আপাতত, উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে আলোচনা এগিয়ে নেওয়া দরকার।
৬. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব-হব করেও শেষ পর্যন্ত (আবেগজনিত) ব্যক্তিগত কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম (১৯৬৯)। আহমদ শরীফ-মুনীর চৌধুরীর মতো শিক্ষকের ছাত্র হতে না পারার জন্য আক্ষেপও হয়েছিল। এখানে পেলাম সৈয়দ আলী আহসানকে। চিন্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গি আর নাটকীয় উপস্থাপনা উপভোগ করা হলো না। বিকল্পে 'অনেক রাত্রে গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দের মতন' অনর্গল শব্দ ঝঙ্কারে স্নায়ুগুচ্ছে ঝিম ধরে গেল। বলা দরকার, কবিতার প্রতি আমার দুর্বলতাই এর একমাত্র কারণ নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার_তিনি এখানে বেশি দিন থাকলেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হওয়ার প্রাক্তন আক্ষেপ আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল।
৭. ১৯৭৩ সাল। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিয়ে ফিরলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবেন_এমনটি শোনা গেল। কেউ বলছে ঢাকায়, কেউ বলছে চট্টগ্রামে। যাঁরা তাঁকে দেখেনি, তাঁরাও শিক্ষক হিসেবে আবু হেনা মোস্তফা কামালের সুখ্যাতির কথা জানতেন। কয়েকজন বন্ধুকে আন্দাজে বলতে থাকলাম, 'জানিস, হেনা স্যার এখানেই আসবেন।' তখন পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে টানাটানি চলছে। আহমদ শরীফ চেয়েছিলেন ঢাকায়, আনিসুজ্জামান ও উপাচার্য আবুল ফজল চেয়েছিলেন চট্টগ্রামে।
আনিস স্যার তাঁকে নিয়ে এলেন চট্টগ্রামে, এ কথা আনিস স্যার একাধিক লেখায় তৃপ্তির সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
৮. হেনা স্যার ক্লাস নিলেন। সেই এক অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা। অপূর্ব এক আনন্দে আমরা নির্বাক হয়ে গেলাম। মনে হলো : এটাকে ক্লাস বলে না, বলে শিল্পকর্ম। এখন বুঝি : সেটা ছিল খড়মরপ আর গধমরপ-এর ঢ়ৎড়ঢ়বৎ পযবসরংঃৎু। 'শুষ্কং কাষ্ঠং' জাতীয় তথ্যরাজি জড়ো করে শিক্ষার্থীদের বিব্রত করতেন না তিনি। অবশ্যই তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল; কিন্তু সেই পাণ্ডিত্যে ছিল লাবণ্য। বাংলায় পড়ছে_এ নিয়ে কেউ কেউ মনখারাপ করত। যখন দেখা গেল, অন্যান্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীও এসে হেনা স্যারের ক্লাস করছে, তারপর থেকে মনখারাপ করা ছাত্ররাও মাথা উঁচিয়ে চলাফেরা করত। কেউ কেউ হয়ে উঠল গরিমাদীপ্ত।
০৫. ০৯. ১৯৭৩ তারিখটা বাদ দিয়ে বলতে পারি_তাঁর কোনো ক্লাস আমি মিস করিনি; অন্য কেউ করেছে বলেও শুনিনি।
৯. শিক্ষকদের সঙ্গে বেশি বেশি যোগাযোগ রাখাটা আমার কাছে শোভন বলে মনে হতো না। তদুপরি বাসায় গিয়ে অধ্যাপকদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার যোগ্যতাও আমার ছিল না। আমার অনেক অযোগ্যতার মধ্যে এটা নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
সেই একদিন, হঠাৎ শুনতে পেলাম, 'এই যে কবি!' চমকে দেখি, করিডর দিয়ে এগিয়ে আসছেন হেনা স্যার। পরের বাক্য_'আপনি বাসায় আসেন না কেন, হেঁ?' কী জবাব দেব, কোনটার জবাব দেব! সালাম দিয়ে প্রকৃতস্থ হওয়ারও উপায় নেই, ওটা ফার্স্ট আওয়ারেই হয়ে গেছে।
কী যেন দুর্বল একটা উত্তর আমি দিয়েছিলাম, যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বললেন, 'কবি হিসেবে তো আসতে পারেন।' সেদিন প্রথম টের পেলাম, 'কবি' শব্দটা মানুষকে কতখানি লজ্জায় ফেলতে পারে।
১০. আমাদের শিক্ষাবর্ষ (১৯৭২-৭৩) থেকে এমএ ক্লাসে থিসিস পেপার চালু হয়। আমি সাব্যস্ত করলাম, শামসুর রাহমানকে গবেষণার বিষয় করব। এতে কোনো কোনো শিক্ষকের আপত্তি ছিল। আপত্তি করার যুক্তিও ছিল : শামসুর রাহমান সিলেবাসভুক্ত 'অথর' নন, তদুপরি জীবিত_যাঁর বয়স পঞ্চাশের কম।
শেষ পর্যন্ত ওই বিষয় নিয়ে কাজ যে করতে পারলাম, সেটা হেনা স্যারের সমর্থনের জোরেই। স্যারের তত্ত্বাবধানে আমি খুবই উপকৃত হয়েছি। বিশেষ করে আমার গদ্য যে কী পরিমাণে কাটাকুটির যোগ্য_তা বুঝতে পেরেছিলাম। আজও আমার বাক্যের দুর্বল মুহূর্তে হেনা স্যারকে মনে পড়ে।
১১. ১৯৭৭ সাল। বাংলা বিভাগে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিলাম। বোর্ডে বিভাগীয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আনিস স্যার। ইন্টারভিউ দিয়েই আমি হাওয়া। পাড়ার চায়ের দোকানে বসে কবিদের নিয়ে আড্ডায় মজে গেলাম। মনোনয়নের খবর যে পাওয়া যায়, তা জানতাম না। আমি যে মনোনীত হয়েছি_খবরটা হেনা স্যার তাঁর অন্যতম স্নেহভাজন ছাত্র সৌরেন বিশ্বাসের মাধ্যমে (অন্য একটি অনুজ্ঞাসহ) পেঁৗছে দিয়েছিলেন। ক্ষুদ্রের প্রতি মনোযোগী থাকার দৃষ্টান্ত এটা_যা সচরাচর দেখা যায় না।
১৯৭৮ সালে ভারত সরকারের বৃত্তি পেয়ে গবেষণার উদ্দেশে আমি কলকাতা চলে যাই। প্রায় কাছাকাছি সময়ে হেনা স্যারও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকায় চলে যান। বিমানবন্দরে আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন ভাইদের মধ্যে একজন, বন্ধুদের মধ্যে একজন এবং শিক্ষকদের মধ্যে একজন। বলাবাহুল্য, সেই শিক্ষক আবু হেনা মোস্তফা কামাল।
১২. আমি চেয়েছিলাম অন্য একটা বিষয় নিয়ে পিএইচডি করতে। তিনি স্পষ্ট বললেন, 'না, আপনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়েই করবেন। আধুনিক কবিতা বা বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে গবেষণা আপনি পরেও করতে পারবেন। মনে রাখবেন, আপনি যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিষয় নেই। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ না বুঝলে আধুনিক কবিতাও ভালোভাবে বোঝা যাবে না।'
১৩. আজ এতদিন পরও শ্রেণীকক্ষে যখন ক্লাস নিতে ঢুকি, অজানা অনুভূতিতে কখনো কখনো আমি কেঁপে উঠি। কী করে ক্লাস নিতে হয়? তৃতীয়বারের মতো প্রকৃত ছাত্র হয়ে ওঠার প্রয়োজন ছিল, খুব প্রয়োজন ছিল। কেননা, হেনা স্যারের কথাকেও আমি কথাসাহিত্যের নতুন শাখা বলে মনে করি। (সাহিত্যের 'অ্যানাটমি' অনেকেই করতে পারেন; কিন্তু সবাই প্রাণসঞ্চার করতে পারেন না)। তিনি আমাদের, আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। অধ্যাপনা শিল্পের মূলমন্ত্রটা বোধ হয় শেখা হলো না। মনে মনে আজও সেই মানুষটির সামনে মাথানত করে দাঁড়াই। মাথার ওপরে অনুভব করি_মেঘের ছায়া, সাহিত্যের মেঘ।

লেখক : কবি ও অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.