সংঘাতের রাজনীতি নয়-রক্ষা করতে হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ

বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ডাকা আজকের হরতাল সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন যে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে, সেটা আগে থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিল। গত সোমবার বিকেলে রাজধানীর কাকরাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের খবরই এই সংঘাতময় পরিস্থিতির পূর্বাভাস দেয়। বিএনপি হরতাল আহ্বানের পর জামায়াত সে হরতালে সমর্থন দিয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো হরতাল প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা যেতে পারে, আজকের হরতালে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
মানতে হবে, যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশেই হরতাল একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার। যেকোনো রাজনৈতিক দলেরই হরতাল আহ্বানের অধিকার রয়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে হরতালকে সব সময় ধরা হয় শেষ অস্ত্র হিসেবে। আমাদের দেশেই বোধ হয় এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়, যেখানে কখনো কখনো হরতালই হয়ে ওঠে প্রাথমিক অস্ত্র। ফলে রাজনৈতিক অধিকার আদায় করতে গিয়ে হরতালের অপব্যবহারও আমাদের দেশে লক্ষ করা গেছে। যেকোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আগে জনমত গঠন করতে হয়। জনমতের দাবি আদায়ের শেষ অস্ত্রটি হচ্ছে হরতাল। আবার হরতাল আহ্বান যেমন একটি রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার, তেমনি হরতাল মানা বা না মানাও দেশের যেকোনো নাগরিকের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশে বারবারই দেখা গেছে, হরতালের মতো কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচি অনেকটা জোর করেই দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। দেশের মানুষকে সেই কর্মসূচি মানতে বাধ্য করা হয়। হরতালের বিরূপ প্রভাব জনজীবনে যে পড়তে পারে, সে কথা অনেক রাজনৈতিক দলই ভাবে না বা ভাবার প্রয়োজনও বোধ করে না। প্রায় প্রতিটি হরতালের সময়ই অফিসগামী মানুষকে নাকাল হতে হয়। পড়তে হয় পিকেটিংয়ের মুখে। যেকোনো নাগরিকের যে হরতাল উপেক্ষা করার অধিকার আছে, সেটা হরতালের পিকেটাররা মানতে চায় না। আবার হরতালের সময় সাধারণের জানমাল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে হরতাল আহ্বানকারীদের সংঘাত-সংঘর্ষ হয়।
এবার বিএনপি ও সমমনা দলগুলো হরতাল আহ্বান করার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রাজপথে হরতাল প্রতিহত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ থেকেই আশঙ্কা, হরতালের পক্ষ-বিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি রাজপথে মুখোমুখি অবস্থান নিলে পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে। দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য এই সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। বিরোধী দল বা বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যে পরিস্থিতিতে হরতাল ডেকেছে, সেটা যৌক্তিক কি না তার জন্য জনমত গঠন করা যেতে পারে। হরতালের বিপক্ষে জনমত গঠনে সরকারি দলই বা কতটুকু দায়িত্ব পালন করেছে? জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আজকের এই হরতাল। হরতালের আগে এ বিষয়ে জনমত সংগঠিত করার দায়িত্ব ছিল বিরোধী দলের। বিরোধী দলও কি সেই দায়িত্ব পালন করেছে?
রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু দায়িত্ব আছে। সে দায়িত্ব দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কতটুকু পালন করছে, সেটাই দেখার বিষয়। সরকার ও বিরোধী দল তো বটেই, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে যথাযথ ভূমিকা পালন করলে অনেক রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সহজে করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা হয়তো থাকবে না। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো অসহিষ্ণু হয়ে উঠলে তাতে দেশের কোনো মঙ্গল হবে না। রাজপথে শক্তির মহড়া প্রদর্শন কোনো রাজনৈতিক সমাধান নয়। রাজনৈতিক মূল্যবোধ উজ্জীবিত রেখে কাজ করতে হবে দেশের মানুষের কল্যাণে। রাজনৈতিক দলগুলোকে সে লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে। দিতে হবে জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক কর্মসূচি। সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করে বেছে নিতে হবে সহনশীলতার পথ। গণতন্ত্রের পথ।

No comments

Powered by Blogger.