মনমোহন সিংয়ের সফর-সহযোগিতার পথে সুন্দর আগামীর জন্য

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে বাংলাদেশে স্বাগতম। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ এবং নন্দিত সংস্কারক। শুধু ভারতে নয়, অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী এ বিনয়ী নেতা অতিসাধারণ জীবনযাপনের কারণে বিশ্বব্যাপী নন্দিত রাষ্ট্রনেতা। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার সফলতার কারণেই ১২১ কোটি লোক অধ্যুষিত ভারত এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে শীর্ষ সারিতে স্থান করে নিয়েছে।
দুই মাস আগে ঢাকা সফরের চূড়ান্ত দিনক্ষণ জানিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোনে তিনি বলেছিলেন, এর 'তাৎপর্য হবে ঐতিহাসিক'। দীর্ঘ এক যুগ পর ভারতীয় কোনো প্রধানমন্ত্রীর এটাই প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। এর মধ্য দিয়ে দু'দেশের সম্পর্ক যদি নতুন মাত্রা লাভ করে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দু'দেশই যদি বাণিজ্য ও কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ কর্মসূচির পথে এগিয়ে যেতে পারে, তিস্তাসহ অভিন্ন নদনদীগুলোর পানি বণ্টনে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ন্যায্য স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়, সীমান্তে বিএসএফের নিষ্ঠুরতার অবসান ঘটে তাহলে প্রকৃত অর্থেই সফরটি ঐতিহাসিক হয়ে উঠবে। সমুদ্র সীমানা চিহ্নিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ভারত যদি নেগেটিভ লিস্ট সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে দু'দেশের বাণিজ্যে ভারতের যে প্রবল আধিপত্য তা যথেষ্ট পরিমাণে কমে আসতে পারে। এতে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ধরনের হেরফের ঘটবে না, কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা অনেক দ্রুত সচল হতে থাকবে। পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক বাড়াতে তা হয়ে উঠবে নিয়ামক। এটা সবারই জানা যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গতিশীল, ব্যাপকতর ও বহুমুখী করার জন্য বেশ কয়েকটি উদ্যোগ অতীতে এসেছে। কিন্তু কখনও ভুল বোঝাবুঝি, কখনও বা আন্তরিকতার অভাব কিংবা রাজনৈতিক পালাবদলে অনেক উদ্যোগ পথ হারিয়েছে। টানাপড়েনের সম্পর্কও তৈরি হয়েছে বহুবার। বিবদমান ইস্যুগুলোতে চাপান-উতোর চলেছে দু'দেশের মধ্যে। তবে সবসময়ই দু'দেশের তরফে এমন শুভশক্তি সক্রিয় থেকেছে, যারা বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতার ফুল ফোটাতে চেয়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় কিন্তু কঠিন সময়ে দু'দেশের মধ্যে যেভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, রক্তের বন্ধনের কারণে যা চিরস্থায়ী রূপ লাভ করবে বলে সৃষ্টি হয়েছিল অভাবনীয় প্রত্যাশা_ তার ধারাবাহিকতায় নতুন অধ্যায় রচনা করতে চেয়েছে। মনমোহন সিং এবং কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী উভয়েই দু'দেশের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনে আন্তরিক। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারও ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সুরাহা চাইছে। ২০ মাস আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিলি্ল সফর যুগান্তকারী হিসেবেই আখ্যায়িত হয়েছিল। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক সমঝোতা এবং বিশেষ করে যৌথ ঘোষণায় উলি্লখিত বিষয়গুলো সৃষ্টি করে আশাবাদ। শেখ হাসিনার সফরের সাত মাস পর বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। এ সময়ে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত ১০০ কোটি ডলারের ঋণ ব্যবহারের বিষয়ে বিশদ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ ঋণের সুদের হার বেশি এবং সম্ভাব্য প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে 'ভারতের স্বার্থই বেশি রক্ষিত হবে' বলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ আরও কিছু মহল অভিযোগ করলেও সার্বিক বিচারে উন্নয়নশীল থেকে দ্রুত বিশ্ব পরিসরে বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চলা ভারতের এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক ঋণ কর্মসূচিকে ইতিবাচক মূল্যায়ন করেছেন অর্থনীতিবিদরা। মনমোহন সিংয়ের সফরকে সামনে রেখে ভারতের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টাও সফর করে গেছেন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা প্রস্তুতিপর্বে একাধিকবার গিয়েছেন দিলি্ল। সব মিলিয়ে বলা যায়, শীর্ষ বৈঠক সফল করার জন্য আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি ছিল না। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে রাজনৈতিক পর্যায়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কাজ বিলম্বিত হলে বিভ্রান্তি বাড়ে, দুই নিকট প্রতিবেশীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক জোরদারে অনুৎসাহী মহলকেও মোক্ষম হাতিয়ার তুলে দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের সময়ে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতাসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যতটা কদম ফেলেছে, ভারত সে তুলনায় তার করণীয় সম্পাদনে পিছিয়ে রয়েছে_ এমন অভিমত খোদ ভারতেই প্রবল। এবারের শীর্ষ বৈঠকে একান্ত প্রত্যাশা যে এমন মনোভাব অতীতের বিষয়ে পরিণত করার জন্য দিলি্ল সাধ্যমতো সবকিছুই করবে। এটা জানা যে, প্রতিটি দেশেরই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বাধ্যবাধকতা থাকে। ভোটের রাজনীতিও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার ইস্যুসমূহকে দেখতে হবে বৃহত্তর স্বার্থের প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। বিভিন্ন ইস্যুতে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থ সর্বতোভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। কোনো কোনো বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপির দিক থেকে এ ব্যাপারে সরকারের প্রতি যে সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে তা বিশেষ বিবেচনা পাবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকেও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া তার মতামত ব্যক্ত করতে পারবেন। সরকারের তরফেও বলা হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি হয় এমন কোনো কিছু তারা করবে না। এটা স্বাভাবিক যে, দুই পক্ষের অবস্থানে কোথাও ভিন্নতা থাকবে, কোথাও বা মিল হবে। কিন্তু বৃহত্তর জাতীয় ইস্যুতে অবশ্যই থাকতে হবে সমঝোতা। আমরা আশা করব, পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত ইস্যুতে জাতীয় সংসদে সরকার ও বিরোধী দল তাদের মতামত তুলে ধরবে এবং সমঝোতার বাতাবরণ তৈরি করবে। এ থেকে ভারতসহ সংশ্লিষ্ট সব দেশও এ বার্তা পাবে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় স্বার্থের প্রধান প্রধান ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ এবং তার প্রতি মর্যাদা দিতেই হবে।
দু'দেশের মধ্যে এমন অনেক সমস্যা রয়েছে, যার মীমাংসা এক বা দুটি শীর্ষ বৈঠকে সম্ভব হবে, এটা কেউ আশা করে না। কিন্তু উভয় তরফেই এমন পদক্ষেপ ফেলতে হবে, যাতে সব মহলে এ বিশ্বাস জন্মে যে আমরা সঠিক পথে রয়েছি। বৈরিতায় নয়, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার পথেই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি_ এটাই সবাই উপলব্ধি করে। এটা কখনও একতরফা হয় না। বাংলাদেশের জনগণ এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এ বহুল প্রতীক্ষিত সফর থেকে ইতিবাচক ফল মিলবে, দূর হয়ে যেতে থাকবে সন্দেহ ও অবিশ্বাস, দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহকে সুন্দর আগামীর পথে নির্বিঘ্নে এগিয়ে নিতে রচিত
হবে নতুন সোপান।
 

No comments

Powered by Blogger.