মনমোহনের সফর-আস্থার সম্পর্কে চিড়

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নিজেই তার বাংলাদেশ সফর 'ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ' হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। সফরের প্রস্তুতি হিসেবে দুই দেশের মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা দিলি্ল ও ঢাকায় বিস্তর দৌড়ঝাঁপ করেন। সম্ভাব্য চুক্তিগুলো পরস্পরের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে সে বিষয়ে উচ্ছ্বাসপূর্ণ অভিমতও ব্যক্ত হতে থাকে।


কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ ৩০ ঘণ্টার ঢাকা সফর কার্যত ব্যর্থই হয়েছে, উভয় দেশের কোটি কোটি মানুষ দারুণভাবে আশাহত হয়েছে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছেন, একান্ত বৈঠকও করেছেন। এ সময়ে উন্নয়ন সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তি, স্থল সীমান্ত সংক্রান্ত ১৯৭৪ সালের চুক্তির প্রটোকল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও দিলি্লর জওয়াহেরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি এবং বিটিভি ও দূরদর্শনের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে কিছু পণ্যকে ভারতের বাজারে প্রবেশের সুবিধাও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এসব তেমন জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয় এবং এ জন্য শীর্ষ বৈঠকেরও প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা ছিল তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ইস্যুর সন্তোষজনক নিষ্পত্তি। এ জন্য ফর্মুলাও প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিলি্ল সফরের ২০ মাস পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকায় ফিরতি সফরের ঠিক একদিন আগে আকস্মিকভাবেই জানানো হয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবল আপত্তির কারণে এ দফায় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই হচ্ছে না। স্যাটেলাইট টেলিভিশন এবং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থার নানা সূত্রে এ খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাব্য ফল নিয়ে ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি মহলে গভীর হতাশার সৃষ্টি হয় এবং এমনকি উভয়পক্ষের একান্ত চেষ্টার পরও তার বিরূপ প্রভাব শীর্ষ বৈঠকে যথেষ্টই পড়েছে বলে ধারণা করা হয়। তিস্তা চুক্তি না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ সরকার ট্রানজিট সংক্রান্ত সম্মতিপত্রে সই করেনি। এ পদক্ষেপ জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ এবং অপর পক্ষের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার মোক্ষম পাল্টা অবস্থান ঠিকই, কিন্তু বল্পুব্দত্ব ও সুপ্রতিবেশিতার সম্পর্ক দৃঢ় করার জন্য পারস্পরিক আস্থা বাড়ানোর কাজ তাতে আরও জটিল হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান বলে সর্বোচ্চ মহল থেকে বিভিন্নভাবে যে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তার প্রতিফলন ঢাকা শীর্ষ বৈঠকে আদৌ ঘটেনি এবং এর দায় একান্তভাবেই ভারতের। এর পেছনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবশ্যই বড় দায় রয়েছে। তার একগুঁয়ে মনোভাব এবং ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশের স্বার্থ গুরুত্বহীন করে দেখার কারণে একটি বড় আয়োজন কার্যত ভেস্তে গেছে। দুই দেশের সম্পর্ক আরও উন্নত ও উষ্ণ করে দক্ষিণ এশিয়া ও আশপাশের দেশগুলোর জন্য আদর্শস্থানীয় করে তোলার প্রচেষ্টা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার আচরণে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্বও কিন্তু দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের তরফেও যে ভুলভ্রান্তি যথেষ্ট তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ নিরসনে একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু বিনিময়ে কী মিলবে সে বিষয়ে কেবল দিলি্লর আশ্বাসে আস্থা রেখেছে, কূটনীতিতে যে যথেষ্ট কূটচাল থাকে, সে সম্পর্কে স্পষ্টতই থেকেছে উদাসীন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার বিষয়ে জনমত গঠন এবং সমাজের বিভিন্ন অংশকে আস্থায় নেওয়ার কাজেও দেখানো হয়েছে উপেক্ষা।
এখন জরুরি হচ্ছে আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং এ জন্য ভারত সরকারকেই প্রধান দায় নিতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের সার্বিক ফলকে এক ধাপ অগ্রগতি বলেছেন। বল্পুব্দত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলায় এখন অনেক ধাপ অতিক্রম করতে হবে এবং তা যে দুরূহ তাতে সন্দেহ নেই। আমরা আশা করব, দ্রুতই আস্থা ও বল্পুব্দত্বের ধারায় ফিরে আসবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং তিস্তার পানি বণ্টনসহ অমীমাংসিত সমস্যাদির সমাধানে দু'পক্ষ মনোযোগী হবে। ঢাকার শীর্ষ বৈঠকের কালো ছায়া তাকে প্রভাবিত করবে না, বরং একে দেখা হবে
 

No comments

Powered by Blogger.