শ্রদ্ধাঞ্জলি-মনে পড়ে শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে

২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি। দিনদুপুরে হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারের জনসভায় দুর্বত্তরা গ্রেনেড ছুড়ে হত্যা করে যে বাংলার মানুষের আপনজন শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে, তিনি ছিলেন সফল অর্থমন্ত্রী ও কূটনীতিক। আট বছর পর এসে যে প্রশ্নটি মনের গহিনে নাড়া দেয় তা হলো, দেশে সরকার আছে, আইনের শাসন আছে, কিন্তু এই নৃশংস হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কি আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি? কী দোষ ছিল এই ক্ষণজন্মা মানুষটির, যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন দেশের গরিব ও ভুখানাঙ্গা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে।


মনে পড়ে, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে এই মানুষটি সক্রিয় ছিলেন। মনে পড়ে মোশাররফ চাচার কথা। একসঙ্গে শৈশব কাটিয়েছি। একাত্তরে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাউদ্দিন হলের ছাত্র। ২৬ মার্চের কয়েক দিন আগেই তিনি চলে গিয়েছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দিতে। আর ফিরে আসেননি। চট্টগ্রাম ফ্রন্টে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি শহীদ হয়েছিলেন। দাদি ছেলের অপেক্ষায় কাঁদতে কাঁদতে শেষ পর্যন্ত অন্ধ হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।
সান্ত্বনা ছিল এই, যে দেশকে আমরা ভালোবাসি সেই দেশের স্বাধীনতার জন্য মোশাররফ চাচা জীবন দিয়েছেন। মনে পড়ে ভাষা আন্দোলনে শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সাহসী ভূমিকার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। ভাষা আন্দোলনের কারণে তাঁকে কিছু দিন গ্রামে থাকতে হয়েছিল। আমাদের বাড়ির এক ঘরের সামনে একটি বাংলাঘর ছিল। ওই ঘরেই কিবরিয়ার থাকা আর পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হলো।
আমি তখন খুব ছোট, তবে স্পষ্ট মনে আছে। সকালের চা-নাশতা শেষ করে মা-চাচিরা আসতেন, বসতেন কিবরিয়ার পড়ার ঘরে গল্পগুজব করতে। একদিন কিবরিয়া মাকে ডাকলেন। বললেন, ‘ছোট চাচি, বরকত, সালাম আর জব্বারের মতো যদি আমার অবস্থা হতো, তবে কত না ভালো হতো, আমি আজ বেহেশতে থাকতাম।’ তিনি মাকে ছোট চাচি বলতেন। ছেলের এই কথা শুনে কিবরিয়ার মা তো কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
সেদিন কিবরিয়া তাঁর মনের আবেগকে বোঝাতে চেয়েছিলেন—কী যন্ত্রণা, অনুশোচনা তাঁকে দগ্ধ করে চলেছিল। সেদিন কি তিনি জানতেন সময়ের ব্যবধানে সেই মানুষটির শরীর একদিন গ্রেনেডের প্রচণ্ড আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে? এই কি দেশের গরিব-দুঃখী মানুষকে ভালোবাসার প্রতিদান?
কেন এমন হলো? কিবরিয়ার জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তাঁর শত্রুও বলতে পারবে না, তিনি কাউকে কোনো দিন কটূকথা বলেছেন বা কারও সামান্যতম ক্ষতি করেছেন। এই সদাসরল মিষ্টভাষী, সদাহাস্যময় যে মুখ, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় ভরপুর—তাঁর জীবন কেন এই নিষ্ঠুর ছোবলের শিকার হলো?
তাঁর লেখা মৃদুভাষণ দেশ-বিদেশে ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-জ্ঞানী-গুণী সবার কাছে ভীষণ সমাদৃত আর সত্যের বর্ণনা হিসেবে পরিচিত হয়েছিল, যা কুচক্রী মহল সহ্য করতে পারছিল না। তাই পরিকল্পিতভাবে তাঁকে এই জগৎ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কারা এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, একটু চেষ্টা করলেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তা উদ্ঘাটন করতে পারবেন।
লন্ডনে দীর্ঘ ১৯ বছর পর যদি স্টিভেন লরেন্সের খুনিদের শাস্তি হতে পারে, তাহলে কেন কিবরিয়ার মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিকের হত্যার বিচার হবে না? দেশের পররাষ্ট্রসচিব থেকে শুরু করে জাতিসংঘের সহকারী সচিব, এসকাপের সেক্রেটারি বা অর্থমন্ত্রী—সবকিছুতেই তিনি ছিলেন সমালোচনার ঊর্ধ্বে অনন্য এক মানুষ। তাঁর খুনিরা আইনকে ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়াবে বা পালিয়ে থাকবে, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা চুপচাপ বসে থাকবে, তা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না।
মনে পড়ে, পাকিস্তান আমলে বাংলার স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তার আগেই জুলফিকার আলী ভুট্টোর নির্দেশে সামরিক বাহিনীর কালো তালিকায় কিবরিয়ার নাম ছিল। একবার কিবরিয়া গভীর দুঃখ করে বলেছিলেন, চাকরিজীবনের সবচেয়ে উদ্বেগের সময় কেটেছে ভুট্টোর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা সব সময়ই বাংলার মেধাবী ছেলেদের হেয় চোখে দেখত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নৃশংস হত্যা আর জেলের ভেতর চার জাতীয় নেতার খুন কিবরিয়াকে বিষিয়ে তুলেছিল। এই সময় সামরিক ছাউনিতে নিষ্ঠুর খুনের ঘটনা তাঁকে ব্যথিত করত। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড তাঁকে হতাশা আর নিরাপত্তাহীনতার গভীরে নিয়ে যায়। এরপর তিনি জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি এবং এসকাপের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। এই সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান রাজনৈতিক, সামাজিক আর অর্থনৈতিক কারণে ইউনেসকোর সাহায্য-ভাতা বন্ধ করে দেন। ফলে সংস্থাটি অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক এবং নিজস্ব উদ্যোগে চীন, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও ভারতের মতো দেশে ঝটিকা সফরে প্রতিনিধি পাঠিয়ে এই অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে কিবরিয়া সুদৃঢ় ভূমিকা রাখেন।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে কিবরিয়ার সাফল্য কিংবদন্তি হয়ে আছে। তাঁর সময় চালু হয় গরিব মানুষের জন্য ভিজিএফ কার্ড, দুস্থ ও বৃদ্ধ ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। তাঁর সময় চাল, ডাল, মাছ, তরিতরকারিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ছিল সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে।
কিবরিয়া হত্যা সারা জাতির জন্য বেদনাদায়ক ঘটনা। এই হত্যার দায় আর কত দিন জাতি বহন করবে? কিবরিয়া পরিবারের এত কান্না, এত আহাজারি আর আসমা কিবরিয়ার মানববন্ধন কর্মসূচি এবং সাধারণ মানুষের এত আর্তনাদ—সবই কি ব্যর্থ হয়ে যাবে?
সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে খুনি আর তাদের নেপথ্যের কুশীলবদের খুঁজে বের করা এবং আইনের কাঠগড়ায় উপস্থিত করা।
আবু মোহাম্মদ ইমাম মেহদী
emmymehdisha@yahoo.co.uk

No comments

Powered by Blogger.