সরল গরল-পার্থে কী পেল বাংলাদেশ? by মিজানুর রহমান খান

নারায়ণগঞ্জ থেকে অস্ট্রেলিয়ার পার্থ বহুদূর। কিন্তু সেই দূরত্ব ঘুচে গিয়েছিল। তার কৃতিত্ব ‘বাপের বেটি’ আইভীর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়। ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ এবারে সিংহাসন আরোহণের ৬০ বছর উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ জন্য তিনি ও তাঁর প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ৩০০ বছরের জং-ধরা উত্তরাধিকার আইন পাল্টাচ্ছেন।


বাপের বেটির ওপরে বাপের বেটার প্রাধান্য ঘুচিয়ে দিচ্ছেন। রাজকুমারীরা বৈষম্যের শিকার ছিলেন। ব্রিটিশ সিংহাসনের প্রতি রাজকুমারদের দাবি ছিল অগ্রগণ্য। কনিষ্ঠ ভাই শুধু ‘পুরুষ’ হওয়ার কারণে বড় বোনকে পেছনে ফেলে সিংহাসনের দাবিদার হতেন। পার্থে পাকা সিদ্ধান্ত হলো, উত্তরাধিকার আইনে সংশোধন করা হবে। ছেলে ও মেয়েসন্তানের পার্থক্য থাকবে না। এখন প্রশ্ন হলো, এ সিদ্ধান্তের প্রতিফলন বাংলাদেশের মতো ব্রিটেনের সাবেক উপনিবেশগুলোতে কি হবে?
উইকিলিকসের একটি তারবার্তা পেলাম। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মাইনাস টু, প্লাস টু’। এক-এগারোতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে মাইনাস টু শুধু নয়, প্লাস টু করা নিয়েও আলোচনা হয়েছিল। সেটা বলার আগে আসুন, আমরা একটু পার্থ ঘুরে আসি।
‘অচিন্তনীয়? কমনওয়েলথ ভেঙে দিন।’ পার্থে কমনওয়েলথ সম্মেলনকে কটাক্ষ করে এটাই ছিল গত ২৮ অক্টোবর ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয়র শিরোনাম। ৫৪টি দেশের সরকারপ্রধানদের ৬১ বছরের সংগঠনটি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ও অকার্যকর। বাংলাদেশসহ এর সব সদস্যরাষ্ট্রই এককালে ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। তাই গর্বিত ব্রিটেন এটা টিকিয়ে রাখতে ব্যাকুল। কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতেই প্রধানমন্ত্রী পার্থে গিয়েছিলেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন ৫৫ জন। এর আগে শতাধিক সফরসঙ্গী নিয়েও তিনি বিদেশে গেছেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে অনধিক ১৫ জন ওই সম্মেলনে গিয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং যাননি। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জন কি পার্থে যাননি। তিনি সম্মেলন উদ্বোধনের দিন অস্কার বিজয়ী ছবি দ্য হবিট দেখেছেন। সামরিক শাসনের কারণে কমনওয়েলথ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল পাকিস্তান। নির্বাচিত সরকারপ্রধান হিসেবে গিলানি প্রথম সেখানে যান।
তাই বলি, জনগণের টাকায় আমাদের এত বড় একটি প্রতিনিধিদল গিয়ে সেখানে কী অর্জন করল? গার্ডিয়ান বলেছে, ‘জনগণের অর্থে কমনওয়েলথ নেতারা পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার নয়নাভিরাম পার্থে দ্বিবার্ষিক “গেট টুগেদারে” রানির সঙ্গে মিলিত হচ্ছেন।’ এই গেট টুগেদার মানে খোশ আলাপ, কারও কারও কাছে আনন্দ ভ্রমণও মনে হতে পারে।
আমাদের প্রতিনিধিদল সেখানে কতটুকু কী অর্জন বা কী ভূমিকা পালন করেছিল, তা আমরা এখনো জানতে পারিনি। তবে সেখানে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান মার্টিন স্টিফেনের সঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দেখা হলে বেশ হতো। স্যার নিনিয়ান মুচকি হেসে বলতে পারতেন, ১৬ বছর আগে আপনি আমার যে ফর্মুলা (৫+৫+১) নাকচ করেছিলেন, সেই কুইনাইন এখন আপনি খালেদা জিয়াকে গিলতে বলছেন। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ তখন স্যার নিনিয়ানের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের নিয়মিত ব্রিফিং একপ্রকার বন্ধ করে দিয়েছে। সামনের ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করা উচিত, অস্ট্রেলিয়া থেকে তাঁরা কী নিয়ে এলেন? অস্ট্রেলিয়া দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে। কিন্তু সেটি নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপ নেয়। এ জন্য তারা ‘কেয়ারটেকার কনভেনশনস-২০১০’ পাস করেছে। এ ধরনের মডেল অনুসরণের কথাও তো আমরা শাসকদের তরফে শুনি না। হাউস অব কমনস তো এটা ধার করছে।
কমনওয়েলথ সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ১০ সদস্যের ‘ইমিনেন্ট পারসনস গ্রুপ’ (ইপিজি) গঠন করা হয়েছিল। তারা ১০৬ দফা সুপারিশ করে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। পার্থে এ বিষয়ে উচ্চকিত ছিলেন ব্রিটেনের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব স্যার ম্যালকম রিফকিন্ড। গত ২৯ অক্টোবর পার্থ থেকে গার্ডিয়ান প্রতিবেদক নিকোলাস ওয়াট লিখেছেন, মানবাধিকার-সংক্রান্ত ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করতে না দিয়ে কমনওয়েলথ নেতারা সমালোচনার শিকার হন। ইপিজি আইনের শাসন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার-বিষয়ক একজন নতুন কমিশনার সৃষ্টির সুপারিশ করেছে। ওই কমিশনারকে একটি ম্যান্ডেট দেওয়া হবে, যিনি সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মানবাধিকার বিষয়ে স্বাধীনভাবে বক্তব্য দেবেন। কিন্তু এ উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখতে বাংলাদেশের মতো অভ্যস্ত দেশগুলো ওই কমিশনার নিয়োগের বিষয়টি সুনজরে দেখতে পারে না। স্যার রিফকিন্ড বলেছেন, ‘কমনওয়েলথ এক ব্যতিক্রমী সমস্যা মোকাবিলা করছে। এটা কোনো বৈরিতা কিংবা বিরোধিতার সমস্যা নয়। এটা হলো অনেক বেশি উদাসীন থাকার সমস্যা।’
বাংলাদেশেও আসলে আমরা একই সমস্যায় ভুগছি। বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনটিও সরকারের নিদারুণ উদাসীনতার শিকার। এটা ছদ্মবেশী বৈরিতা। ইপিজির প্রতিবেদনটি গোপন রাখা হলেও তা পরে ফাঁস হয়ে যায়। এর পূর্ণ বিবরণ পড়ে মনে হয়েছে, এর বাস্তবায়ন করতে পারলেই শুধু এ সংস্থার টিকে থাকা উচিত। সবচেয়ে খুশি হয়েছি এটা দেখে যে তারা সামরিক শাসন ও নির্বাচিত স্বৈরশাসনকে এক পাল্লায় না মেপেও এর ধ্বংসাত্মক দিক অভিন্ন বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। নির্বাচিত স্বৈরশাসনও যে আইনের শাসনের বারোটা বাজাতে পারে, তা স্যার ম্যালকম, আসমা জাহাঙ্গীরেরা চমৎকারভাবে চিহ্নিত করেছেন।
ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ কীভাবে আছে, সেটা হূদয়ঙ্গম করতে গার্ডিয়ান সম্পাদকীয় থেকেই উদ্ধৃতি দেব। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘ওই প্রতিবেদনে, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা (সরকার যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত) থেকে বাংলাদেশ হয়ে নাইজেরিয়া এবং তার বাইরেও চরম উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।’
পার্থ থেকে নারায়ণগঞ্জে আসি। আমরা কয়েকটি স্ববিরোধিতা লক্ষ করতে পারি। পার্থে অন্যতম থিম ছিল ‘উইমেন এজ এজেন্টস অব চেঞ্জ’। সেই অর্থে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ছিলেন ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’। পার্থ থেকে ফিরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি পার্থের নারী মেয়রকে বলেছিলেন, ‘আমার দেশেও একজন নারী মেয়র হতে চলেছেন।’ পার্থের ওই নারী লিজের সঙ্গে আইভীর মিল আছে। দুজনেরই চিকিৎসায় ডিগ্রি আছে। দুজনেই নিজ নিজ শহরের প্রথম নারী মেয়র। লিজও ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। তবে পার্থের মেয়রকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় বলেননি, তিনি ও তাঁর তিন দশকের নেতৃত্বাধীন দল আইভী নামের ‘চেঞ্জ এজেন্ট’কে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ ছিল।
আমাদের দুই নেত্রী নারীকে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ হিসেবে বিশ্বাস করেন কি? ক্ষমতাসীন দলের সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল, সংসদে ১০০ নারী আসন বাড়ানো হবে। সরাসরি ভোট হবে। কিন্তু প্রমাণ মিলল, সংসদে তাঁরাও তাঁদের ‘অলংকার’ হিসেবে দেখতে চান। আইভী যে আওয়ামী লীগে ছিলেন, থাকবেন এবং কখনো ‘বেইমানি’ করবেন না, ফুলের তোড়া হাতে পরাজিত প্রার্থী শামীম ওসমানের সঙ্গে তাঁর ও প্রধানমন্ত্রীর যে আলোকচিত্র এবং ‘মিলেমিশে’ কাজ করার খবর পত্রিকায় ছাপা হলো, সেই বাংলাদেশই আপাতত আসল বাংলাদেশ।
এ থেকে আমরা মাইনাস টু নয়, প্লাস টু মেনে নিই। এবং তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিই। ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে সিংহাসনে রক্তের উত্তরাধিকার এবং একই সঙ্গে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর তকমা দুটো একসঙ্গে চলছে। অথচ আমরা তা মুখে স্বীকার করি না। উইকিলিকসে দেখি, এক-এগারোতে দুই নেত্রীকে একটি ‘সিরিমনিয়াল’ ভূমিকা দিয়ে তাঁদের নির্বাসনে না পাঠানোর পরিকল্পনাও ছিল।
সোনিয়াও একটি মডেল। তবে বাংলাদেশের রাজনীতি আরও জটিল। ৬০ বছর আগের ও পরের এলিজাবেথ এক নয়। ক্রমাগতভাবে তিনি আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজালে নিজকে বন্দী করেছেন। নাগরিকদের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও আইনের শাসনে নিজকে সমর্পণ করেছেন। আর ৩০ বছর ধরে ক্রমাগতভাবে আমাদের এলিজাবেথদ্বয় তাঁদের একচ্ছত্র ক্ষমতার বলয় বিস্তৃত করে চলেছেন। তাঁরা অধিকাংশ সময় ‘আইনের শাসনের’ শর্তাবলি ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছেন। আপত্তিটা এখানেই। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এটাই বড় হুমকি।
আইভীকে জেতানোর লাভের গুড় কি ইতিমধ্যে পিঁপড়ায় খেতে শুরু করেছে? অর্জন বিসর্জনে পরিণত হওয়াই কি আমাদের ভবিতব্য। জনতার রাজকুমারী হয়তো প্রাসাদের রাজকুমারী হয়ে উঠবেন; উঠতে তাঁকে বাধ্য করা হবে। এই চক্কর থেকে বাঁচতেই আমাদের ভাবতে হবে, একটি উপযোগী উত্তরাধিকার আইন লাগবে কি লাগবে না। আসল সমস্যা এই মডেল অন্তত ওয়েস্টমিনস্টার রাজতন্ত্রে নেই। আমাদের সম্ভবত পরিবারতন্ত্রকে পোষ মানাতে ও পুষতে শিখতে হবে। দুই নেত্রী কখনো উচ্চারণ করেননি যে তাঁরা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বাইরেও, অর্থাৎ ভিন্ন রক্তের উত্তরাধিকারী কেউ অন্তত এক মেয়াদের জন্যও দল বা সরকারপ্রধান হতে পারেন। সমাজও কি এটা শুনতে প্রস্তুত নয়!
 মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.