শ্রদ্ধাঞ্জলি-অনুপ্রাণন রণেশ দাশগুপ্ত

১৯৮৯ সালের জুলাই মাসের এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যা। সেদিন কলকাতার সিআইটি রোডসংলগ্ন পদ্মপুকুরের (সুন্দরী মোহন এভিনিউ) লেনিন স্কুলে গিয়েছিলাম। নাচোলের রানিমা বিপ্লবী নেত্রী ইলামিত্রের সঙ্গে যাওয়া হয়েছিল। আমরা গিয়েছি বিপ্লবী সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। লেনিন স্কুলে ইলাদি আমার সঙ্গে রণেশদার পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁর কাজে চলে গিয়েছিলেন। রণেশদা প্রথম পরিচয়েই সেদিন আমায় প্রায় তিন ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন।


দ্রুত আপন করে নেওয়ার অনন্য ক্ষমতাসম্পন্ন রণেশদা পুরো সময়টাই আমার বিচিত্র প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আমি সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সংকটে হতাশাগ্রস্ত যুবক তাঁর সঙ্গে এক বৈঠকেই সজীব হয়ে উঠলাম। জেনে এলাম, তিনি লিখছেন সাম্যবাদী সমাজের পুনরুত্থানের প্রত্যাশা নিয়ে নতুন বই। শুনেছি অনেকের কথা, যাঁরা তাঁর স্নেহ-সান্নিধ্যে জীবনসংগ্রামে দ্রোহী হতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
এই অনুপ্রাণন রণেশ দাশগুপ্তের জন্ম ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি। তিনি বরিশালের বিএম কলেজে বিএ (অনার্স) ইংরেজিতে ভর্তি হন। এর মধ্যে বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ক্রিকেট খেলতে গিয়ে পঙ্গু হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তখন রণেশ দাশগুপ্ত পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় এসে সোনার বাংলা পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হন। ইতিমধ্যে তিনি যুক্ত হন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। পার্টির কমরেড হিসেবে ১৯৩৯ সালে ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। তারপর দীর্ঘ ২৮ বছর তিনি (১৯৭৫ সাল পর্যন্ত) বিরতিহীনভাবে কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করেছেন, লিখেছেন, দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় চাকরি করেছেন এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছেন। আর মাঝেমধ্যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আক্রোশের কারণে কারাবন্দী হয়েছেন। কারাগারে থেকেও তিনি লিখেছেন এবং অন্যকে লিখতে উৎসাহিত করেছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কারাবন্দী মুনীর চৌধুরীকে অনুপ্রাণিত করে লিখিয়েছেন এবং কারাগারে মঞ্চস্থ করিয়েছেন কালজয়ী নাটক কবর। স্নেহভাজন কমরেড শহীদুল্লা কায়সারকে লিখতে উৎসাহিত করেছেন। সমকালের অনেক খ্যাতনামা শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকের অনুপ্রেরণা ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত।
রণেশ দাশগুপ্ত রাজনীতি করলেও সাহিত্য-সংস্কৃতি ছিল তাঁর প্রকৃত কর্মভূমি। আশির দশকের ওই পরিচয়ের বৈঠকে জেনেছি লুকাসের তত্ত্ব: সংস্কৃতিই হচ্ছে মূল লক্ষ্য, রাজনীতি সেই লক্ষ্য সাধনের একটি উপায় মাত্র—এই প্রত্যয়ের সঙ্গে ছিল রণেশ দাশগুপ্তের একান্ত একাত্মতা। তাই সংস্কৃতিসাধনা ছিল তাঁর জীবনসাধনা। আর মার্ক্সীয় জীবনাদর্শই ছিল তাঁর জীবনসাধনার মূল প্রেরণা। সে কারণে বাংলাদেশের গণসংস্কৃতিচর্চার স্বনামখ্যাত প্রতিষ্ঠান উদীচীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে উদীচী দেশব্যাপী শাখা সংসদে বিস্তৃত হয় এবং উদীচী সৃষ্টির অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়।
রণেশ দাশগুপ্ত যে কত সামাজিক ও প্রিয়ভাষী ছিলেন, তার দৃষ্টান্ত আছে অনেক। তাঁর গণসংযোগ ও জনপ্রিয়তা ছিল অবিশ্বাস্য রকম। ১৯৫৭ (মতান্তরে ১৯৫৮) সালে ঢাকা পৌরসভার নির্বাচনে তিনি শাঁখারীবাজার-তাঁতিবাজার-ইসলামপুর এলাকা থেকে ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন ৩৫টি পদের মধ্যে ৩৪টি পদেই নির্বাচিত হয়েছিলেন মুসলিম লীগের প্রার্থী অথবা ঢাকার সর্দাররা। রণেশদার কাছে মুসলিম লীগের প্রার্থীসহ ছয়জন প্রার্থী পরাজিত হন। মুসলিম লীগের প্রবল দাপটের সময় একজন কমিউনিস্টের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। মিশুক রণেশ দাশগুপ্ত সেই কষ্টসাধ্য কাজটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
রণেশ দাশগুপ্ত রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখ্য হলো—উপন্যাসের শিল্পরূপ, আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রাম, শিল্পীর স্বাধীনতা, আলো দিয়ে আলো জ্বালো, আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ ইত্যাদি। এসব গ্রন্থ তাঁর অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করছে।
এই বিপ্লবী ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চলে যান কলকাতায়। সেখানে গিয়ে সক্রিয় হন কমিউনিস্ট পার্টিতে। আমৃত্যু থেকেছেন পার্টিতে। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর এই অকৃতদার বিপ্লবী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কলকাতায়। তবে তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁর মরদেহ দাহ করা হয় তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে। মরদেহ বাংলাদেশে আনতে খুব সমস্যা হয়। কারণ, তিনি ভারতীয় নন, অথচ মৃত্যুবরণ করেছেন ভারতে। তবে দুই দেশের সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সমস্যার সমাধান হয়। এ সময় বিশেষ সহযোগিতা করেছেন রণেশ দাশগুপ্তের অসম্ভব স্নেহধন্য মতিয়া চৌধুরী।
আজ রণেশ দাশগুপ্তের চতুর্দশ মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা।
রতন সিদ্দিকী, অধ্যাপক ও নাট্যকার

No comments

Powered by Blogger.