‘গোড়ার কথা’ by আবুল হায়াত

কাজের ব্যস্ততায় উত্তরের ঝোলা বারান্দায় দাঁড়াবার সময়টুকু পর্যন্ত হয় না। তাই নীপবনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে যেন আমার। পাঠককুলকেও আর দেওয়ার ফুরসত হয়ে ওঠে না নীপবনের খবর।
আজ অকারণেই শুটিং বাতিল হওয়ায় বুকভরে একটু নিশ্বাস নেওয়ার আশায় ঘুম ভাঙতেই এসে দাঁড়ালাম প্রিয় বারান্দাটায়। সুন্দর, অদ্ভুত সুন্দর ঝকঝকে সকাল। মনেই হচ্ছে না কদিন আগেও—
‘দারুণ অগ্নিবাণে রে হূদয় তৃষায় হানে রে
রজনী নিদ্রাহীন, দীর্ঘ দগ্ধদিন, আরাম নাহি যে প্রাণে রে।’
পয়লা বৈশাখেই একপশলা বৃষ্টি দিয়ে গেছে প্রকৃতি। তাতে স্নাত হয়ে স্নিগ্ধ মধুর রূপ ধারণ করেছে আমার নীপবন। সবুজের মেলা বসেছে এই কংক্রিটের বস্তির মাঝখানে। পাশেই কৃষ্ণচূড়ার চূড়ায় লাল রঙের ছোপ ধরেছে। বাগানবিলাসগুলো আমার বারান্দার শোভাও বর্ধন করেছে। আজ মনে হয় কিডস টিউটোরিয়াল বন্ধ। কোলাহল নেই বললেই চলে। ঢাকার চিরাচরিত ট্রাফিক জ্যাম শুরু হতে এখনো ঘণ্টাখানেক দেরি। লিখতে বসলাম। কিন্তু কী নিয়ে লিখব?
বিদ্যুৎ? কিন্তু এ নিয়ে এত লেখা হয়েছে যে মানুষ বিরক্ত হবে। বরং আমার নিজের কথা দিয়েই শুরু করি। সেই সাতচল্লিশের দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গেই বাবা-মায়ের সঙ্গে চলে আসি চট্টগ্রাম। সেই সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে। মুর্শিদাবাদের সেই গ্রামে যেমন কুপি-হারিকেনের আলোয় তিন বছর জীবন কেটেছে, সেই একই রকমভাবে শুরু চট্টগ্রাম টাইপাস রেলওয়ে কলোনিতে। কুপি-হারিকেন দিয়ে অ-আ, ক-খ শুরু হয়েছিল। বিদ্যুৎ কী জিনিস চোখে দেখা তো দূরের কথা, নামও শুনিনি। কদিন যেতেই দেখলাম বাসার সামনে রাস্তায় বিশাল খাম্বা পোঁতা হলো, কদিন পর তার টানাও দেখলাম। তারপর একদিন অবাক বিস্ময়ে বাতিও জ্বলতে দেখলাম রাস্তায় খাম্বার মাথায়। প্রায়ই বসে যেতাম সন্ধ্যার পর পাটি বিছিয়ে বাগানে, ওই লাইটপোস্টের ঠিক নিচেই। স্বল্প সে আলোয় পড়তাম—‘জল পড়ে পাতা নড়ে’।
তারপর কয়েক বছর যেতেই দেখলাম মিস্ত্রি চলে এল বাসায়। হাতে ব্যাটেন, ক্লিপ, তার, সুইচ, সকেট, প্লাগ, লাইট, কত কিছু। দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম ওদের কাজ। জ্বলল একদিন বাসার ভেতরে বৈদ্যুতিক বাতি। আহ! সে কী আনন্দ। নিজের পড়ার টেবিলে বিদ্যুতের আলোয় পড়া শুরু করার আনন্দটা আজ বোধহয় কাউকে বোঝাতে পারব না।
এখনো মনে পড়ে, প্রথম দিকে বাসায় সংযোগ দেওয়া হয়েছিল রাস্তার বাতির লাইন থেকে। ফলে দিনভর আমাদের অপেক্ষা চলত কখন জ্বলবে রাস্তার বাতি, আর আমরা ঘরে সুইচ টিপব। অপেক্ষা শেষের আনন্দের নেই কোনো তুলনা।
নাহ, সেই ঘুরেফিরে বিদ্যুৎই চলে এল। কী করি বলুন। তবে সমস্যার কথা না বলে চলুন বিদ্যুতের গোড়ার কথায় যাই।
বিদ্যুৎ কে আবিষ্কার করেন? না কোথাও খুঁজে পাবেন না আবিষ্কর্তার নাম। কারণ বিদ্যুৎ কাউকে উদ্ভাবন করতে হয়নি। খুঁজে নিতে হয়েছে। এই খোঁজকর্তা অনেক অনেকজন।
বিদ্যুৎ আসলে সব সময়ই ছিল, শুধু জ্ঞানের অভাবে ব্যবহূত হয়নি। গ্রিকদের বিশ্বাস, দেবতাদের দেবতা জিউস বিদ্যুৎ বহন করে এনেছেন এই ধরাধামে। তিনি হলেন মেঘের দেবতা, প্রকৃতির দেবতা, বজ্রদেবতা। মোটকথা, তিনিই হলেন পুরো আকাশের দেবতা। তিনিই মানুষকে দিয়েছেন বিদ্যুতের অবদান। তবে অনেকের বিশ্বাস, বিদ্যুৎ এনেছেন দেবী ইলেকট্রা। তিনিই আকাশ, সমুদ্র, ঝড়-ঝঞ্ঝা, মেঘের বিদ্যুতের দেবী। তাঁর ইলেকট্রা নাম থেকেই আমরা বিদ্যুতের নাম পেয়েছি ‘ইলেকট্রিসিটি’।
সবই ঠিক আছে। কিন্তু আবিষ্কার করল কে (who discovered)? সেই গোঁড়ার কথা খুঁজতে গিয়েই এত কথা।
কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে পেলাম কিছু নাম। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, তবু বলি—টমাস এডিসন, নিকোলা টেলসা, উইলিয়াম গিলবার্ট, ভোল্টা, অ্যাম্পার, ফ্যারাডে, ফ্রাংলিন। এঁদের মধ্যে গিলবার্ট ১৬০০ সালের দিকে ইলেকট্রা-ম্যাগনেট নিয়ে যথেষ্ট কাজ করেছেন। ফ্যারাডে সাহেব ১৮৩১ সালে জেনারেটর উদ্ভাবন করেন, যা আজ বাংলাদেশের মানুষের জন্য আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিরূপে বিরাজ করছে। আর এডিসন সাহেব তড়িত্ শক্তির ওপর গবেষণা করে ১৮৭৯ সালের ২১ অক্টোবর প্রথম বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালান।
বিদ্যুৎ-বাতি জ্বলার তারিখ জানতে পারলেও কেন যেন বিদ্যুতের গোড়ার কথাটা পরিষ্কার জানা হলো না। বরং জানলাম হারিকেনের ইতিকথা। শুনবেন, শুনতেই হবে, কারণ এই লোডশেডিংয়ে ওটাই তো বন্ধু। চীনারা শুরু করেছিল প্রাচীন যুগে। চীনামাটির বেজের (base) ওপর কাচের খোপ বসিয়ে তার ভেতরে শতশত জোনাকি পোকা ঢুকিয়ে হারিকেন তৈরি করা হতো পথচলার সুবিধার জন্য। তারপর নানা হাত ঘুরে আজ এই সর্বশেষ চেহারা হারিকেনের। চমকপ্রদ না, বলেন?
বিদ্যুতের গোড়ার কথা খুঁজতে যখন এত দূর এলাম, তাহলে এই বাতি ঢাকায় কবে জ্বলল, সেটাও জেনে নেওয়ার একটু চেষ্টা করি আসুন। আমার এক প্রকৌশল জার্নাল বলছে, ১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত লেফেটন্যান্ট গভর্নর বোল্টন সাহেব আহছান মঞ্জিলে এক সুইচ টিপে ঢাকা শহর বিদ্যুতায়ন শুরু করেন।
সকাল থেকে নানা বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটিতে বিরক্ত শিরিন এবার অধৈর্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল
‘কী শিখছ এত বই ঘেঁটে?’
‘বিদ্যুতের গোড়ার কথা।’ ঘামতে ঘামতে উত্তর দিই।
‘এ তো সহজ, এর জন্য এত বই ঘাঁটতে হবে কেন?’ বেগম সাহেবা হেসেই বললেন এবার।
‘কী বল তো?’ জেগে উঠলাম আমি।
‘খাম্বা।’
‘খাম্বা?’
‘হ্যাঁ খাম্বাই তো। দেখনি, আগের সরকার বিদ্যুৎ দিক আর না দিক, কোটি কোটি টাকার খাম্বা দিয়ে গেছে। আর তারই পথ অনুসরণ করে এঁরাও খাম্বা কিনেছে।’ বলেই তিনি তাঁর কাজে চলে গেলেন। ভাবতে বসলাম আমি আবার। তাই তো! এটাই তো আজ আমাদের বিদ্যুতের গোড়ার কথা। আর হাতে হারিকেন তো আছেই!
ঢাকা, ১৭/০৪/২০১০
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.