ভিয়েতনামের ঐতিহ্য: দো সনের ষাঁড়ের লড়াই

বড় বড় কালো চোখ আর শান্ত স্বভাব দেখে বোঝার উপায় নেই, ষাঁড়গুলোর একমাত্র কাজ লড়াই করা। শুধু কাস্তে আকৃতির কালো একজোড়া শিং জানান দিচ্ছে, বড় ধরনের আঘাত করার সামর্থ্য তাদেরও রয়েছে। এদের কোনো নাম নেই। শুধু নম্বরের মাধ্যমে পরিচয় পাওয়া যায় এসব ষাঁড়ের। এরা সবাই ভিয়েতনামের দো সন শহরের ষাঁড়ের লড়াই প্রতিযোগিতার প্রতিযোগী। ভিয়েতনামের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বন্দর নগর হাইফংয়ের কাছে অবস্থিত শহরটিতে প্রতিবছর এ প্রতিযোগিতার আসর বসে।
প্রতিযোগিতার আয়োজকেরা জানালেন, দো সন শহরের ষাঁড়ের লড়াই শত শত বছরের পুরোনো। ভিয়েতনামের ঐতিহ্য এই ষাঁড়ের লড়াই। ঐতিহ্যবাহী এই ষাঁড়ের লড়াই এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি উত্সবে পরিণত হয়েছে। কারণ উত্সবের পৃষ্ঠপোষকেরা এতে বেশ ভালো অর্থ খরচ করে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মোটা অঙ্কের পুরস্কার দেওয়া হয়। পাশাপাশি প্রতিযোগী ষাঁড়গুলো ঘিরে বড় ধরনের জুয়ার আসর বসে। তবে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের জন্য অর্থের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজেদের গোষ্ঠী-মর্যাদা।
প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া একটি ষাঁড় সম্পর্কে এর মালিক লুং ত্রাক তাই (৭৫) বললেন, ‘আমার ভাগ্নে লং দুই হং-কে একটি ভালো ষাঁড় খুঁজে বের করতে বলেছিলাম। কয়েক মাস খোঁজাখুঁজির পর সে এই ষাঁড়টি খুঁজে বের করে।’ ছয় কোটি ডং (ভিয়েতনামের মুদ্রা) বা তিন হাজার ৪১৩ ডলার খরচ করে ষাঁড়টি কেনে লুং ত্রাক তাইয়ের পরিবার। এরপর একে প্রশিক্ষিত করতে আরও চার কোটি ডং খরচ হয়।
ত্রাক তাই বললেন, ‘কুঁজের ওপর ও উরুর দুই পাশের পাতলা লোম প্রমাণ করে, ষাঁড়টি সাহসী। তাই আমরা একে বেছে নিয়েছি। তবে লড়াইয়ে জিততে সাহসের পাশাপাশি প্রশিক্ষণও দরকার।’ তাইয়ের ভাগ্নে হং জানালেন, ‘একজন ক্রীড়াবিদের মতো করেই একে প্রশিক্ষণ দিয়েছি আমি।’ হংয়ের ষাঁড়ের নম্বর ১৮। দুটো বাছাইপর্ব পার করে চূড়ান্তপর্বে পৌঁছায় এটি। এখন এদের মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে; কিন্তু প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত দিনই এই সম্পর্কের শেষ দিন। কারণ হারুক বা জিতুক, প্রতিযোগিতার শেষে প্রতিটি ষাঁড়কেই জবাই করা হয়। এগুলোর মাংস বেশ ভালো দামে বিক্রি হয়। কারণ প্রচলিত সংস্কার হচ্ছে, এসব ষাঁড়ের মাংস সৌভাগ্য বয়ে আনে।
হং জানালেন, জবাইয়ের সময় তিনি ষাঁড়টির কাছে থাকতে চান না। ষাঁড়ের মাংস বিক্রি থেকে এর পেছনের খরচের কিছুটা তুলে আনতে পারে মালিক। পাশাপাশি প্রতিযোগিতার পুরস্কার রয়েছে চার কোটি ডং। তবে হং জানালেন, এখানে ষাঁড়ের লড়াইকে তাঁরা ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করেন না। বরং ঐতিহ্য আর মর্যাদার কথা স্মরণ করেই তাঁরা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।
কয়েক হাজার দর্শকে পরিপূর্ণ স্থানীয় স্টেডিয়ামে প্রতিযোগী ষাঁড়গুলো লড়াইয়ে নামে। প্রতিবার দুটো প্রতিপক্ষ ষাঁড় লড়াই করে। কয়েক মিনিট স্থায়ী লড়াইয়ে যে ষাঁড়টি আগে রণে ভঙ্গ দেয়, সেটিকে পরাজিত ঘোষণা করা হয়।
হাইফং থেকে লড়াই দেখতে আসা দর্শক এনগুইএন ভান হাং (২৯) বললেন, ‘এটা অনেকটা মার্শাল আর্টের মতো মনে হয়। দুটো ষাঁড়ের শিংয়ের সংঘর্ষ রোমহর্ষক শব্দ তৈরি করে। তবে ষাঁড়গুলো রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে আমার খারাপ লাগে।’
স্থানীয় সূত্রে দো সন শহরে ষাঁড়ের লড়াই প্রতিযোগিতার সূচনা সতেরো শতকের দিকে। ওই সময় একজন পাদরির নামে উত্সর্গ করার জন্য আনা দুটো ষাঁড় নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে। আর এর মধ্য দিয়েই এ প্রতিযোগিতার সূচনা। তবে শুধু দোন শহরেই নয়, ভিয়েতনামের অন্যান্য শহরেও প্রতিবছর ষাঁড়ের লড়াই অনুষ্ঠিত হয়।

No comments

Powered by Blogger.