প্রেমিকাকে নিয়ে ফুর্তির টাকা জোগাড় করতেই খুন by আহমেদ মুসা

প্রেমিকাকে নিয়ে ফুর্তি ও তাকে বিয়ে করার টাকা জোগাড় করতেই আপন খালাতো ভাইয়ের স্ত্রী নাসিমা আক্তার ও তার মেয়ে ফাল্গুনী আক্তার রিয়াকে হত্যা করে বাসা থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নেয় বেলাল হোসেন (১৯)। মা-মেয়ে খুনের দায় স্বীকার করে বেলাল বুধবার বিকালে মহানগর হাকিম রহমতউল্লাহর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে সে হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে।
হত্যার পর কাপড় পাল্টে এসে লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাওয়া, পোস্টমর্টেম শেষে জানাজা পড়ে লাশ দাফন করে আসাসহ সব কাজই করেছে সে। নানা কারণে পুলিশ তাকে সন্দেহ করে তিনবার আটক করলেও তার চাতুর্যপূর্ণ কথাবার্তা আঁচ করতে না পেরে ছেড়ে দেয়। বেলাল হোসেনই যে মা-মেয়ের ঘাতক তার প্রমাণ পেয়ে তাকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর বেলাল পুলিশের কাছে এ হত্যাকাণ্ডের রোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়া এলাকার একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। পরে অভিযান চালিয়ে বাকলিয়ার বাসা থেকে লুণ্ঠিত স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। ঘাতক বেলাল গ্রেফতারের মধ্যদিয়ে ঘটনার ২০ দিন পর উন্মোচিত হল মা-মেয়ে খুনের রহস্য।
বুধবার দুপুরে ঘাতক বেলালকে সিএমপির সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। সেখানে সে খুনের বর্ণনা দেয়। পুলিশ জানায়, বেলাল হিংস্র প্রকৃতির লোক। তার আপন খালাতো ভাই মাংস বিক্রেতা শাহ আলম। সেই সূত্রে শাহ আলমের স্ত্রী নাসিমা খালাতো দেবর বেলালকে স্নেহ করত। প্রায় সময় তার বাসায় আÍীয়তার সূত্রে আসত। একইভাবে নাসিমাও বেলালকে চাচ্চু সম্বোধন করত। কিন্তু বেলালই যে তাদের নিষ্ঠুর ঘাতক হয়ে উঠবে সেটি কল্পনাও করতে পারেনি নাসিমার স্বামী শাহ আলম। বেলাল পেশায় একজন ইলেট্রিশিয়ান মিস্ত্রি।
যেভাবে গ্রেফতার ঘাতক : সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়ার মাংস ব্যবসায়ী শাহ আলমের স্ত্রী নসিমা আক্তার ও তার স্কুলপড়ুয়া ৫ বছরের মেয়ে ফাল্গুনী আক্তার রিয়াকে বেলাল ছুরিকাঘাত ও জবাই করে হত্যা করে গত ৭ মে। এ খুনের ঘটনায় পুলিশ কোনো কিছুই রহস্য উন্মোচন করতে পারছিল না। অনেকটা অন্ধকারে কেটে যায় ১৬ দিন। শাহ আলমের বাসার দুটি মোবাইল সেট ঘটনার পর চুরি হয়। এই মোবাইল চোর খুঁজতে গিয়েই পুলিশ ঘাতকের সন্ধান পায়। পুলিশ জানায়, চুরি যাওয়া দুটি মোবাইলের ওপর নজর রাখে পুলিশ। এ দুটি সেট ট্র্যাকিং করতে থাকে। ২৩ মে হঠাৎ নিহত নাসিমা আক্তারের চুরি যাওয়া দুটি মোবাইলের একটি সচল হয়। গোয়েন্দা পুলিশ খুঁজে পায় অন্ধকার সুড়ঙ্গে আলোর দিশা। নিহত নাসিমার সচল হওয়া মোবাইল ফোনের কল ট্র্যাকিং করতে গিয়ে বের হয়ে আসে খুনির তথ্য। গ্রেফতারকৃত বেলাল মা-মেয়েকে খুনের পর নাসিমার মোবাইল ২টি ও আলমিরা থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর মোবাইল দুটি বেলালের প্রেমিকা ফারজানার কাছে জমা দেয়। পরে এ দুটি মোবাইল থেকে একটি মোবাইল ফারাজানাকে ‘উপহার’ হিসেবে দেয়। প্রেমিকা ফারাজানা মোবাইলটা তার আপন বড় ভাইকে দিয়ে দেয়। মোবাইল ফোনটি সচল করলে সেই ভাই গোয়েন্দা পুলিশের গোয়েন্দা জালে আটকা পড়ে। এরপর মোবাইল ট্র্যাকিং করে প্রেমিকার ওই বড় ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে পাওয়া য়ায় বেলালের নাম।
যেভাবে হত্যা করা হয় মা-মেয়েকে : জিজ্ঞাসাবাদে বেলাল জানায়, ৭ মে সকালে নালাপাড়ায় শাহ আলমের বাসায় হানা দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সকাল ৯টা ১৫ মিনিটের দিকে গৃহকর্তা শাহ আলম দুই ছেলে নিয়ে স্কুলে চলে গেলে বেলাল ৯টা ২২ মিনিটের দিকে একটি ছুরিসহ বাসায় প্রবেশ করে। বাসায় ঢুকে নাসিমাকে সালাম দেয়। নাসিমা বেলালকে জিজ্ঞেস করে নাস্তা করছে কিনা এবং কী কাজে বাসায় এসেছে। এর উত্তর না দিয়েই বেলাল কোমর থেকে ছুরি বের করে নাসিমার পেটে আঘাত করে। এ সময় নাসিমা বাঁচার জন্য চেষ্টা করে। দু’জনের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে নাসিমা ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লে ঘাতক বেলাল তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। পরে তাকে জবাই করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরই পাশের রুমে ঘুমিয়ে থাকা পাঁচ বছরের শিশুকন্যা রিয়া ঘুম থেকে জেগে সামনের রুমে আসে। মায়ের রক্তাক্ত লাশ দেখে চিৎকার করলে তাকে মুখ চেপে ধরে বাথরুমে নিয়ে যায় বেলাল। তাকেও উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। একপর্যায়ে শিশু রিয়ার বুকে পাড়া দিয়ে জবাই করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে নিষ্ঠুর ঘাতক বেলাল। এরপর নিহত নাসিমার কোমর থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুলে টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যায় সে। স্বর্ণ বিক্রির টাকা দিয়ে বেলাল একটি টেলিভিশন, একটি ডিভিডি প্লেয়ার, দুটি সাউন্ড বক্স কেনে। পুলিশ সেগুলোও উদ্ধার করেছে। বেলাল কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর ইউনিয়নের কোরবানপুর গ্রামের মনা মিয়ার ছেলে। পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান ও টিউবওয়েল মেরামতকারী। সে আড়াই বছর আগে চট্টগ্রামে আসে বলেও পুলিশ জানায়।
প্রেমিকাকে নিয়ে ফুর্তি ও তাকে বিয়ে করতেই হত্যা : পুলিশ জানায়, ঘাতক বেলাল ফারজানা আক্তার নামে এক পোশাক কর্মীর সঙ্গে প্রেম করছে দু’বছর ধরে। সম্প্রতি ফারজানা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। কিন্তু টাকা-পয়সা না থাকায় সে প্রেমিকাকে বিয়ে করতে পারছিল না। তাকে নিয়ে কোনো ফুর্তিও করতে পারছিল না। ফারজানাকে বিয়ে করে তাকে সুখে রাখতে খালাতো ভাইয়ের স্ত্রী ও মেয়েকে হত্যা করে টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে সে। বুধবার পুলিশের সামনেও বেলাল বলে, ‘আমি টাকার লোভে ভাবী ও ভাতিজি ফাল্গুনীকে হত্যা করেছি।’ সে আরও জানায়, কিছুদিন ধরে তার প্রেমিকা ফারজানা তাকে বিয়ে করার জন্য ও ফুর্তি করার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। প্রেমিকা ফারজানার চাপের মুখে টাকার সংস্থান করার জন্য এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটায় সে।
৬০ হাজার টাকায় প্রেমিকাকে নিয়ে হোটেলে ৩ দিনের ফুর্তি : বেলাল লুট করা নগদ ৬০ টাকা নিয়ে ফয়’স লেক এলাকার একটি হোটেলে প্রেমিকা ফারজানার সঙ্গে তিনদিন আমোদ-ফুর্তি করে। এ সময় তারা দামি দামি সব খাবার খায়। শাহ আলম পরিবারকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ঘাতক বেলাল শরীর ভাসায় আমোদ-ফুর্তিতে। সংবাদ সম্মেলনে শাহ আলম তার দু’ছেলেকে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে যুগান্তরকে বলেন, আমি বেলালের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি চাই।

No comments

Powered by Blogger.