সংস্কারপন্থীদের দলে ফেরাতে চান খালেদা জিয়া by নজরুল ইসলাম

ওয়ান-ইলেভেনের সময় কথিত সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত যারা এখনও দলের বাইরে রয়েছেন তাদের ঘরে ফেরানোর চিন্তাভাবনা করছে বিএনপির হাইকমান্ড। কয়েকজন নেতাকে এ বিষয়ে কাজ করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। বিএনপিতে ব্যাপক রদবদলের খবরে এসব সংস্কারপন্থী নেতাও নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছেন। দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গেও নানা মাধ্যমে শুরু করেছেন যোগাযোগ। অতীতের সব বদনাম ঘুচিয়ে সুযোগ পেলে আবারও দলের জন্য সর্বোচ্চটা দিতে চান তারা। তাই সবকিছু ভুলে তাদের দলে ফিরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেবেন বলে প্রত্যাশা তাদের। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামিনে মুক্ত হলে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। সংস্কারপন্থী নেতারা স্বীকার করেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে অদৃশ্য একটি শক্তি বন্দুকের নলের মাথায় রেখে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আলাদা একটি কমিটি করতে নেতাদের বাধ্য করেছিল। কথিত সংস্কারপন্থী ও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার ধানমণ্ডির নিজের বাসায় বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক জহির উদ্দিন স্বপন যুগান্তরকে বলেন, আমরা চেয়ারপারসনের ডাকের অপেক্ষায় আছি। তিনি যখনই বলবেন তখনই দলে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চাই। যদিও আমি বিভিন্ন টিভি টকশোতে দলের পক্ষে সোচ্চার রয়েছি। তিনি দাবি করেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নানা প্রলোভন দেখানো হলেও আমরা কেউই তাতে পা বাড়াইনি।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষক জিয়াউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের আদর্শে উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারা মওলানা ভাসানীর ধারাবাহিকতাতে শুরু করেছিলেন। সার্ক গঠন করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্মানজনক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সার্কের চেতনা- এই তিনটি মৌলিক প্রশ্নে বিএনপি কিছুটা বিভ্রান্ত। জনগণের কাছে এসব বিভ্রান্ত স্পষ্ট করা গেলে ও অতীতের সব ভুলকে সংশোধন করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দল পরিচালনা করলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আবারও সরকার গঠন করা সম্ভব হবে। জানা যায়, ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সেনাসমর্থিত সরকারের সময়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে শতাধিক সাবেক এমপি ও সিনিয়র নেতা অবস্থান নিয়েছিলেন। দলের হাইকমান্ড এ কারণে তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও যুগ্ম মহাসচিব আশরাফ হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কার করে। এই দুই নেতার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার না করে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতাদের ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। অনেককে গুরুত্বপূর্ণ পদেও বসানো হয়। বাকিদের কোনো পদ-পদবি দেয়া হয়নি।
তবে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতা যারা দলে ও দলের বাইরে রয়েছেন তাদের মতে, ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে পর্দার অন্তরালের অদৃশ্য শক্তির চাপে পড়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দলে সংস্কারের প্রস্তাব এনেছিলেন। ওই প্রস্তাবে যারা মূল ভূমিকা পালন করেন তাদের অনেককেই পরে দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে দক্ষ অনেককে দলে নেয়া হয়নি। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাদের দলে নেয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক হলেও অদৃশ্য কারণে তাদের নেয়া হয়নি। তারপরও তারা হতাশ না হয়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গেই যুক্ত রয়েছেন।
দলের কোনো পদ-পদবি না থাকলেও দলের পক্ষে কাজ অব্যাহত রেখেছেন বলে যুগান্তরকে জানান বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য সরদার শাখাওয়াত হোসেন বকুল। সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত এ নেতা সোমবার বিকালে রাজধানীর গুলশানে তার বাসায় যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ওয়ান-ইলেভেন প্রসঙ্গে আর কথা বলতে চাই না। অতীতের সব খারাপ ভুলে থাকতে চাই। এখন দলের পক্ষে কাজ করছি। নরসিংদী আমার নির্বাচনী এলাকা। সেখানকার নেতাকর্মীরা সব ভেদাভেদ ভুলে আজ ঐক্যবদ্ধ। আশা করি এবার দল তাকে মূল্যায়ন করবে। সংস্কারপন্থী নেতা যাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দলে কোনো পদ-পদবি নেই তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা যারা দলে পদ-পদবি ছাড়া রয়েছি, হাইকমান্ডও তাদের নিয়ে পজিটিভ ভাবনা শুরু করেছে। তিনি জানান, দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেফতার হওয়ার এক সপ্তাহ আগেও তাদের মধ্যে এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে। তার আগেও দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার উপস্থিতিতে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামিনে মুক্ত হলে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে বলে আশা করছেন এই সংস্কারপন্থী নেতা। সূত্র জানায়, সম্প্রতি দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, দলে আর কোনো ভেদাভেদ দেখতে চাই না। সব ভেদাভেদ ভুলে দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই। তার এই মনোভাব থেকে সামনের কাউন্সিলে যোগ্যদের মূল্যায়ন করা হবে। তার আগে ভেদাভেদ ভুলে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ হতে দলের হাইকমান্ড থেকে আহ্বান জানানো হতে পারে। কথিত সংস্কারপন্থীদের দলে ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই এমন বার্তা দেয়া হতে পারে। জানা যায়, বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মোফাজ্জল করিম, অধ্যাপিকা শাহরিয়া আক্তার বুলু, আবদুল খালেক, এহসানুল কবির, শাম্মী শের, দৈনিক দিনকাল পত্রিকার সাবেক সম্পাদক কাজী সিরাজের ব্যাপারে বিএনপির হাইকমান্ড অনেকটা নমনীয়। অতীতের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে তাদের বিষয়ে বিবেচনা করবে বিএনপির হাইকমান্ড। তৎকালীন মহাসচিব কর্তৃক বহিষ্কৃত দফতর সম্পাদক মফিদুল হাসান তৃপ্তিকে দলে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারেও হাইকমান্ড ইতিবাচক। এছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য এবং দলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক জহির উদ্দিন স্বপন ও সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুলের বিষয়ে দলের হাইকমান্ডের মনোভাব এখন অনেকটাই ইতিবাচক। বিশেষ করে সংকটকালীন সময়ে তারা উভয়ই টকশোতে দলের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন, যা হাইকমান্ডের দৃষ্টি কেড়েছে। তবে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত জেডএ খান ও বহিষ্কৃত যুগ্ম মহাসচিব এবং সাবেক হুইপ আশরাফ হোসেনকে দলে না ফেরানোর ব্যাপারে তৃণমূলের ব্যাপক চাপ রয়েছে। নিকুঞ্জে তার বাসায় আলাপকালে আশরাফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বিএনপিতে ফেরার আর কোনো ইচ্ছেই নেই। হ্যাঁ ফিরতে পারি, যদি আমাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো দলে বাস্তবায়ন করা হয়। সংস্কারপন্থীদের ব্যাপারে দলের মনোভাব ইতিবাচক হলে সাবেক সংসদ সদস্য নজির হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার শহীদুজ্জামান, একেএম আনোয়ারুল ইসলাম, বিচারপতি মোজাম্মেল হক, দেলোয়ার হোসেন খান দুলু, আবু আব্বাস, ধীরেন্দ্র নাথ সাহা, ডা. জিয়াউল হক মোল্লা, জিএম সিরাজ, ডা. সালেক চৌধুরী, শাহ মোহাম্মদ আবুল হোসেন, এসএ সুলতান টিটু, অধ্যাপক মো. ইউনূস, আবদুল মতিন, আলমগীর হায়দার খান, অ্যাডভোকেট আবু রেজা ফজলুল হক, আনোয়ারুল হোসেন খান চৌধুরী, আলহাজ আমানউল্লাহ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট দেওয়ান শাহজাহান ইয়ার চৌধুরী, ডা. মো. সানাউল্লাহ, মাইনুদ্দিন ভুঁইয়া, ইলেন ভুট্টো, হোসনে আরা, রেকেয়া আহমেদ লাকী, তাসমিন রানাসহ প্রায় অর্ধশত নেতার দলে জায়গা হতে পারে। সাবেক হুইপ শহীদুল হক জামাল ও সাবেক সংসদ সদস্য আবু হেনা এখন এসব সংস্কারপন্থী নেতার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেন না। অভিযোগ রয়েছে, ওই দুই নেতার সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত রয়েছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে তারা ওই দুজনকে এড়িয়ে চলছেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে সংস্কারপন্থীদের অনেককেই মনোনয়ন দেয়া হয়। ২০০৯ সালের কাউন্সিলেও দেয়া হয় গুরুত্বপূর্ণ পদ। সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিতদের মধ্যে যারা পরবর্তীকালে ফিরে এসে দলের বর্তমান কমিটিতে স্থান নিয়েছেন তারা হলেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, সাদেক হোসেন খোকা, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম দাদু ভাই, হারুনুর রশিদ খান মুন্নু, মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, শামসুজ্জামান দুদু, ফজলুর রহমান পটল, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মুমিন তালুকদার খোকা, লুৎফর রহমান খান আজাদ, জাকারিয়া তাহের সুমন, নাজিম উদ্দিন আলম, স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদক আবদুল হাই, পল্লী উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক মনিরুল হক চৌধুরী, আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমান খান, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু, অর্থনৈতিকবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম, সহ-প্রচার সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স, সহ-পল্লী উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক মোজাহার আলী প্রধান, সহ-ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সম্পাদক আমজাদ হোসেন, নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক রেজাউল করিম, নাসির উদ্দিন চৌধুরী, মাসুদ অরুন, আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়াম, নাসিরুল হক সাবু, বিলকিস ইসলাম, নুরুল হুদা, খুররম খান চৌধুরী, কাজী আলাউদ্দিন, মোশাররফ হোসেন, আবদুল খালেক, কর্নেল (অব.) আনোয়ারুল আজিম, জিএম ফজলুল হক, এমএ ওয়াব, অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন, মোশাররফ হোসেন ও ইয়াসমিন আরা হক।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর তৎকালীন বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দলের কিছু সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ওই ঘটনায় মান্নান ভূঁইয়া ছাড়াও দলের তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব আশরাফ হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কার করেন খালেদা জিয়া। এ সময় খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করেন তিনি।
খালেদা জিয়া কারাগারে থাকাবস্থায় সংস্কারপন্থীরা বিএনপির আলাদা একটি কমিটিও গঠন করেন। ওই কমিটিতে সাইফুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ও মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদকে মহাসচিব ঘোষণা করা হয়। এ বিষয়ে সংস্কারপন্থী অংশের নেতা জহির উদ্দিন স্বপন যুগান্তরকে বলেন, ওই সময়ে অদৃশ্য একটি শক্তি বন্দুকের নলের মাথায় রেখে ওই কমিটি করতে নেতাদের বাধ্য করেছিল। তবে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার মুক্তির পর তাদের অনেকেই মূল দলে ফিরে আসেন। এ পরিস্থিতিতে তারা সংস্কারপন্থী বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করেন।

No comments

Powered by Blogger.