৫ দিনের পরিকল্পনা ধর্ষণে অংশ নেয় দু’জন

পাঁচ দিনের পরিকল্পনা। মূল হোতা আশরাফ খান ওরফে তুষার। প্রথম দেখার পরই গারো তরুণীকে ধর্ষণের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করে সে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলে অপর তিন চালক বন্ধু লাভলু, ফিরোজ ও খোকনের সঙ্গে। সবাই মিলে পরিকল্পনা করে কর্মস্থল থেকে বেরোনোর পর মাইক্রোবাসে তুলে মেয়েটিকে ধর্ষণ করবে। কিন্তু ঘটনার দিন তুষার শুধু লাভলুকে সঙ্গে নিয়ে যায়। জোর করে মেয়েটিকে তুলে নেয় মাইক্রোবাসে। মেয়েটি বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু জানে মেরে ফেলার ভয় দেখানোয় মেয়েটি আর উচ্চবাচ্য করেননি। এরপর তুষার প্রথমে ধর্ষণ করে মেয়েটিকে। পরে গাড়ি এক জায়গায় থামিয়ে তুষার গিয়ে বসে চালকের আসনে। আর চালকের আসন থেকে পেছনের সিটে চলে আসে লাভলু। সেও ধর্ষণ করে মেয়েটিকে। বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য ভয়ও দেখায়। পরে তাকে নামিয়ে দিয়ে আসে জসীম উদ্‌দীন রোডে। ঘটনার একদিন পর পত্রিকা ও টেলিভিশনে ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে পালিয়ে যায় দু’জনই। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় গিয়ে আত্মগোপন করে তুষার। আর লাভলু ছিল রাজধানীতেই। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে মঙ্গলবার রাতে পটুয়াখালীর কলাপাড়া এলাকা থেকে প্রথমে তুষারকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় লাভলুকে। গতকাল এই দু’জনকে উত্তরার র‌্যাব সদরদপ্তরে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। এ সময় গারো তরুণীকে ধর্ষণের বিস্তারিত বর্ণনা দেয় তুষার (৩৫) ও লাভলু (২৬)। এর আগে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-এর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, আলোচিত এই ঘটনার প্রথম থেকেই ধর্ষকদের ধরতে র‌্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। একপর্যায়ে প্রযুক্তিগত তদন্তের মাধ্যমে তুষারকে শনাক্ত করা হয়। এরপর তুষার গ্রেপ্তারের পর তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয় জাহিদুল ইসলাম ওরফে লাভলুকে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বনানীর ২১ নম্বর সড়কের ৬০/বি নম্বর বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ধর্ষণের সময় ব্যবহৃত মাইক্রোবাসটি (ঢাকা মেট্রো চ-১৫-৪৭০১)। মুফতি মাহমুদ খান জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত দুই যুবক ধর্ষণের পুরো ঘটনাটি স্বীকার করেছে। ঘটনাটি তারা দু’জনই ঘটিয়েছে বলেও স্বীকার করে তারা।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গ্রেপ্তারকৃত তুষার জানায়, সে সিগনেট নামে একটি বায়িং হাউজে চালক হিসেবে কাজ করে। তাদের মালিকের অ্যাটকন নামে আরেকটি বায়িং হাউজ রয়েছে। সেখানে সাউথ আফ্রিকার দুই নারীও কাজ করে। ওই দুই বিদেশী নাগরিককে নিয়ে সে গত ১৭ই মে যমুনা ফিউচার পার্কে গিয়েছিল। সেখানকার টেক্সটমার্ট থেকে তাদের বস দুই আফ্রিকান নারী দীর্ঘ সময় নিয়ে কেনাকাটা করে। এ সময় তুষার তাদের সঙ্গেই ছিল। টেক্সমার্টের ওই শো-রুমেই সেলস গার্ল হিসেবে কাজ করা গারো তরুণীর সঙ্গে তার কথা হয়। কথাবার্তার একপর্যায়ে মেয়েটি আফ্রিকান দুই নারীর বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করে। জবাবে তারা একসঙ্গে একটি বায়িং হাউজে চাকরি করে বলে জানায়। এ সময় মেয়েটি তার কাছে বায়িং হাউজে চাকরি পাওয়া যাবে কিনা জানতে চায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তুষার মেয়েটির কাছ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে নেয়। তাৎক্ষণিক মেয়েটিকে মিসড কল দিয়ে নিজের নম্বরও দিয়ে আসে। পরদিন সকাল ১০টার দিকে তাদের মধ্যে একবার কথা হয়। তুষার এ সময় মেয়েটিকে বলে বায়িং হাউজে কাজ করতে হলে  বায়িং কোর্স করতে হবে জানিয়ে তাকে ফরেন ডেস্কে চাকরি পাইয়ে দিতে পারবে বলে জানায়। এজন্য তার কাছে একটি সিভি চায়। এরপর দু’দিন ওই মেয়েটির সঙ্গে মোবাইলে কথোপকথন ও এসএমএস আদান-প্রদান হয়। ঘটনার একদিন আগে ২০শে মে মেয়েটির সঙ্গে উত্তরার জসীম উদ্‌দীন রোডে দেখা করে। এ সময় তুষার তার কাছে একটি বায়োডাটা দিতে বলে। মেয়েটি পরদিন কাজ শেষে বায়োডাটা দিবে বলে জানায়। ২১শে মে রাত ৯টার দিকে তারা যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে পরিচয়ের পর থেকেই মেয়েটিকে কৌশলে ধর্ষণ করার পরিকল্পনা আঁটে। বিষয়টি সে একই প্রতিষ্ঠানের অন্য চালকবন্ধু লাভলু, ফিরোজ ও খোকনকে জানায়। তারা চারজন মিলে মেয়েটিকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ঘটনার দিন তুষার ফিরোজ ও খোকনকে না জানিয়ে লাভলুকে সঙ্গে নিয়ে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে যায়।
তুষার জানায়, গত ২১শে মে রাত পৌনে ৯টার দিকে তারা  যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। এ সময় মোবাইলে মেয়েটির সঙ্গে কথাও হয়। এ সময় দারা দু’জন পাশের একটি হোটেলে পরাটা ও কাবাব খেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। মেয়েটি এলে প্রথমে তার কাছ থেকে বায়োডাটাটি নেয়। পরে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মেয়েটিকে উত্তরা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার অফার করে। মেয়েটি মাইক্রোবাসে যেতে অস্বীকৃতি জানালে তারা জোর করে মেয়েটিকে মাইক্রোবাসে উঠায়।
তুষার জানায়, মাইক্রোবাসে ওঠার পর সে পেছনের সিটে মেয়েটির পাশে বসে। আর লাভলু গাড়িটি ধীরে ধীরে চালাতে থাকে। গাড়ি কিছুক্ষণ চলার পরপরই তুষার মেয়েটির সামনেই তার ফুলপ্যান্ট খুলে একটি শর্টপ্যান্ট পরে। একপর্যায়ে পাশে বসা অবস্থায় মেয়েটির গায়ে হাত দেয় তুষার। মেয়েটি এ সময় বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তুষার তাকে নানা ভয় দেখায়। এমনকি চিৎকার করলে মেরে ফেলারও ভয় দেখায়। তুষারের ভাষ্য, মেয়েটিকে প্রথমে সে ধর্ষণ করে। পরে ফ্লাইওভার পেরিয়ে পূর্বাচলের দিকের রোডে একজায়গায় গাড়ি থামিয়ে তুষার গিয়ে চালকের আসনে বসে। আর চালকের আসনে থাকা লাভলু পেছনের সিটে গিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। পুরো সময়টাতে ধীরে ধীরে গাড়িটি চালাতে থাকে। এ সময় ফ্লাইওভারের ওপরে একাধিকবার চক্কর দেয় তারা। পরে মেয়েটিকে নিয়ে জসীম উদ্‌দীন রোডে নিয়ে নামিয়ে দেয় তারা। জানতে চাইলে একই বর্ণনা দেয় লাভলুও।
র‌্যাব-এর এক কর্মকর্তা জানান, এ ঘটনায় তারা তুষার ও লাভলুর পরিকল্পনার সঙ্গে থাকা অপর দুই চালকবন্ধু ফিরোজ ও খোকনকেও আটক করেছেন। তবে ধর্ষণের ঘটনায় সরাসারি এই দু’জন সম্পৃক্ত ছিল না। তবে তারা পুরো বিষয়টি জানতো। তাদের সঙ্গে না নেয়া উল্টো তারা তুষার ও লাভলুর ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। র‌্যাব-এর ওই কর্মকর্তা জানান, এই দুজন ধর্ষণের ঘটনার সাক্ষ্য দিতে রাজি হয়েছে। এজন্য তাদের সাক্ষী করা হতে পারে।
উল্লেখ্য, গত ২১শে মে রাত ৯টার দিকে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে কুড়িল বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে গারো তরুণীকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। একদিন পর ২১ বছর বয়সী ওই তরুণী ভাটারা থানায় অজ্ঞাত ৫ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় তরুণী  চলন্ত মাইক্রোবাসে পাঁচজন মিলে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে তাকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ করে। বিষয়টি দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়।

No comments

Powered by Blogger.