বিলিয়ন ডলার বাজারে আমাদের ভাগ by এস এম আশ্রাফ আবির

একটা সময় ছিল খুব জিনিয়াস না হলে তথ্যপ্রযুক্তিকে পেশা হিসেবে নেবে, এমন মানুষ খুঁজেই পাওয়া যেত না আর বেশি মেধাবী মানেই বিদেশ চলে যাওয়া। কিন্তু আজকের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ মানুষ দিয়ে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন অ্যাসোসিয়েশন বেসিসের নিবন্ধিত আইটি বা আইটিইএস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯০০-রও বেশি। প্রায় আড়াই লাখ ডেভেলপারের কর্মসংস্থান হয়েছে, এর বাইরে প্রায় ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। বাংলাদেশ খুব শিগগির সারা বিশ্বে প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দেবে। ২০১৮ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে এক বিলিয়ন ডলার আয় করা আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু শুধু লক্ষ্য থাকলেই হবে না, তার জন্য প্রযুক্তি বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ প্রয়োজন।
তথ্যপ্রযুক্তির বিলিয়ন ডলারের বাজারে ঢোকার আগে আমাদের অনেক কাজ বাকি। এর মধ্যে প্রথম হলো দেশের অভ্যন্তরীণ তথ্যপ্রযুক্তির বাজার আরও বড় করা। কমপক্ষে কয়েক বিলিয়ন ডলারের অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি করা। এই বাজার কীভাবে হবে? দেশে সরকারি-বেসরকারি যত তথ্যপ্রযুক্তির ক্রয় হয়, নিশ্চিত করতে হবে তার অন্তত ৫০ শতাংশ বা তার বেশি আমাদের দেশি আইটি কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারকারী এবং ইন্টারনেটকে জনপ্রিয় করতে হবে, ইন্টারনেটকে নিয়ে যেতে হবে প্রান্তিক মানুষের কাছাকাছি এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। ইন্টারনেটের ওপর সম্পূর্ণ ভ্যাট তুলে নিয়ে ইন্টারনেটের দাম এখনই কিছুটা কমিয়ে ফেলা সম্ভব। প্রয়োজনে কিছু সময়ের জন্য সরকারিভাবে ভর্তুকি দিয়ে হলেও আরও কম মূল্যে ইন্টারনেট সেবার প্রসার ঘটাতে হবে। এতে রাজস্ব আয় কিছুটা কমার আশঙ্কা থাকলেও সরকারকে মনে করতে হবে এই ভর্তুকি একধরনের বিনিয়োগ। এর রিটার্ন আমরা পাব অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। দেশের সাড়ে ১২ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে অন্তত ১০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করলে তার পরোক্ষ প্রভাব অর্থনীতিতে কত গুণ বেশি পড়বে, সেই হিসাব করে এই সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই।
কম্পিউটার থেকে দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে মোবাইল ফোন। মোবাইল চালানোর জন্য আলাদা কোনো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। আর এ জন্যই মোবাইলের প্রসার আমাদের খুব দ্রুত হচ্ছে, এর পাশাপাশি স্থানীয় উপযোগী কনটেন্ট ও সেবা মোবাইল উপযোগী করে তুলতে পারলেই ১৬ কোটি মানুষের দেশে অভ্যন্তরীণ একটা বিশাল নতুন বাজার তৈরি হবে। এই সব দিক বিবেচনা করেই মোবাইল হ্যান্ডসেটের ওপর কর সম্ভব হলে রেহাই দিতে হবে। যত ব্যবহারকারী বাড়বে, প্রযুক্তিভিত্তিক সেবা নিয়ে কাজ করার উৎসাহ পাবে আমাদের আইটি কোম্পানিগুলো, তারা নতুন ধরনের সেবা নিয়ে আসবে। যারা নতুন আইটিভিত্তিক বিভিন্ন উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী, তাদের সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রণোদনা দিতে হবে, শুধু ট্যাক্স মওকুফ করে দিলেই হবে না, সেই সঙ্গে তার জন্য আর্থিক উৎস তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি পুনঃ অর্থায়ন তহবিল থেকে বিনিয়োগ করতে হবে।
নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করার জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবনী স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনই সহজ শর্তে হাইটেক পার্কে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক পণ্যের মূল্যায়ন করার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ নির্দেশ দিতে হবে। দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কাজ করে বা তাদের অফিস আবাসিক এলাকায়। অথচ সরকারিভাবে বাণিজ্যিক এলাকা ছাড়া বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানোর অনুমতি নেই। তার মানে দেশের এই ৯০ শতাংশ আইটি কোম্পানিগুলো ভুয়া ঠিকানা দিতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, তাদের বাণিজ্যিক এলাকায় অফিস করার মতো সামর্থ্য নেই, আর এর জন্য ট্যাক্স বা ভ্যাট নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে। অবাণিজ্যিক এলাকায় আইটি প্রতিষ্ঠান করা যাবে, সরকারি দিক থেকে তা নিশ্চিত করতে হবে। আইটি প্রতিষ্ঠানের বাড়িভাড়া বাবদ যে ৯ শতাংশ মূসক রয়েছে, তা পুরোপুরি তুলে দিতে হবে।
সারা দেশে কয়েক বছর ধরে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ছোট-বড় নানা বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক একটি ভবিষ্যৎ জাতি প্রস্তুতের জন্য কলেজ, ইউনিভার্সিটির বাইরে বিশেষায়িত হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। শুধু প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ধীরে ধীরে সংযোগ ঘটাতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের আগে স্থানীয় অনলাইন বাজার গড়ে তুলতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে এই প্রশিক্ষিত তরুণেরা স্থানীয় বাজারে কাজ করে দক্ষ হবে, তারপর নিজে থেকেই বিদেশের বাজারে প্রবেশ করতে পারবে। ইংরেজিতে কথা বলা ও লেখা যেহেতু একটা বড় সমস্যা, এর জন্য আমাদের গার্মেন্টসের বার্মিংহাম কনসেপ্টের মতো ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গড়ে উঠতে পারে, যাদের কাজ হবে বায়ার ও দক্ষ প্রযুক্তিকর্মীর মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়া। সহজ শর্তে কম্পিউটার-ল্যাপটপ এমনকি স্মার্টফোন দেওয়ার কথাও সরকারকে ভাবতে হবে। শুরু থেকেই বলতে হবে আপনার সন্তানকে তথ্যপ্রযুক্তিতে শিক্ষিত করে তুলুন।
বাংলাদেশের সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি এখনো সার্ভিসপ্রধান। এ দেশের ছোট বা মাঝারি কোম্পানিগুলো এখন অন্যের জন্য সফটওয়্যার বা বিভিন্ন প্রযুক্তিভিত্তিক সেবা দিয়ে নিজেদের মেধা খরচ করছে। বিলিয়ন ডলার বাজারে ভাগ বসানোর প্রধান শর্ত হচ্ছে প্রোডাক্ট-নির্ভর কোম্পানি গড়ে তুলতে হবে শুরু থেকেই। হতে পারে আইডিয়াগুলো বাস্তবায়ন হবে দেশে, কিন্তু ভবিষ্যতে স্কেলআপ করা যাবে সারা বিশ্বে। ছোট, বড়, মাঝারি, মিনি, মাইক্রো, মেগা যেকোনো আইডিয়া মোবাইল অ্যাপ, ই-কমার্স সফটওয়্যার প্রোডাক্ট, বিনিয়োগের আশা না করেই শুরু করে দেওয়া উচিত। নিজের উদ্ভাবনী শক্তিতে বিশ্বাস থাকলে নিজের জমানো টাকা বা ঋণ নিয়ে, জায়গাজমি বিক্রি করে নেমে পড়তে হবে এবং লেগে থাকতে হবে। সামনে যাঁরা বিনিয়োগ করবেন, তাঁরাই খুঁজে নেবেন আপনাকে। প্রোডাক্ট উদ্ভাবন নিয়ে সরকারি–বেসরকারি সব জায়গায় এখন জোর দেওয়ার সময় হয়েছে। আওয়াজ তুলুন মেইড ইন বাংলাদেশ।
এস এম আশ্রাফ আবির: পরিচালক, বেসিস এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমসিসি লি.।
abir@mcc.com.bd

No comments

Powered by Blogger.