মাটি খুঁড়তেই বের হচ্ছে মানুষের হাড়গোড়

মালয়েশিয়ার জঙ্গলে গণকবর থেকে মানুষের
দেহাবশেষ উদ্ধার করছে পুলিশ -এএফপি
গহিন জঙ্গলে পাচারকারীদের ২৮টি বন্দিশিবির। তার ফাঁকে ফাঁকে ১৩৯টি গণকবর। কবর খুঁড়তেই বেরিয়ে আসছে মানুষের হাড়গোড়-মাথার খুলি, চোয়াল, মেরুদণ্ড। বীভৎস এ দৃশ্য দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি পুলিশ, উদ্ধারকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী ও উপস্থিত সাংবাদিকরা। মঙ্গলবার মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় পেরলিস প্রদেশের বুকিত ওয়াং বার্মার জঙ্গলের গণকবর থেকে সন্দেহভাজন বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের একটি মরদেহ ও বেশকিছু দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। ঠিক কতজনের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে এ বিষয়ে মুখ খোলেনি পুলিশ। তারা জানিয়েছে, দেহাবশেষগুলো শনাক্ত করতে ফরেনসিক বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিন পুলিশের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সংবাদকর্মীরা পাচারকারীরদের আস্তানা ও গণকবর ঘুরে দেখেন। এএফপি, বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর-
ঘন জঙ্গলের ভেতর একটু পরপর মানব পাচারকারীদের বন্দিশিবির। বন থেকে সরু গাছ কেটে এগুলো বানানো হয়েছে। মাটি থেকে এক হাতের মতো ওপরে কাঠ অথবা সুরু গাছের গুঁড়ি বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর একই কায়দায় কোনোটি দোচালা কোনোটি একচালার মতো করে গাছ বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। তা ঢেকে দেয়া হয়েছে বড় আকারের পলিথিনের মাধ্যমে। বন্দিশালা থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে দেয়া হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। যাতে কেউ পালাতে না পারে। পুলিশ জানায়, সবচেয়ে বড় যে ক্যাম্পটি তারা দেখেছেন, তাতে প্রায় ৪০০ লোককে রাখা হয়েছিল।
মঙ্গলবার সেখানে সাংবাদিকরা দেখেন বেশির ভাগ বন্দিশিবিরই অনেক পুরনো। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ১০ বছর ধরে পাচারকারীরা ওইসব বন্দিশিবিরে অভিবাসীদের নির্যাতন চালিয়ে আসছিল। অভিবাসী প্রত্যাশীদের ধরে এনে তারা সেখানে বন্দি করে রাখত এরপর মুক্তিপণের দাবিতে অমানুষিক নির্যাতন চালাত। অত্যাচার-অনাহারে অসুস্থ হয়ে যারা মারা যেত তাদের গণকবর দিয়ে দিত তারা।
চার ঘণ্টা ধরে সাংবাদিকরা কয়েকটি গণকবর ও বন্দিশিবির ঘুরে দেখেন। সেখানে বিশাল বড় একটা পানির ট্যাঙ্ক, বিভিন্ন পাত্র ও গৃহস্থালির নানা জিনিসপত্র দেখতে পান তারা। কয়েকটি ক্যাম্প থেকে পুলিশের তোলা ছবিতে দেখা যায়, ছোট শিশুর সেন্ডেল, টেডি বিয়ার, জামা-কাপড় ইত্যাদি। পুলিশের পক্ষ থেকে ছবিগুলো সাংবাদিকদের দেয়া হয়। এ সময় লুকিয়ে থাকা সশস্ত্র পাচারকারীদের সম্ভাব্য হামলার আশংকায় পুলিশ সাংবাদিকদের পরামর্শ দেন তারা যেন গুলির শব্দ পেলে মাটিতে শুয়ে পড়েন।
এ দিন গণকবর খুঁড়ে একটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাছাড়া কোথাও কোথাও পাওয়া গেছে মানুষের হাড়গোড়-দেহাবশেষ। মরদেহটি পাওয়া যায় একটি সাদা রঙের বড় একটি পলিথিনের ব্যাগে। পুলিশ জানায়, দেহাবশেষটি কোনো মুসলিম ব্যক্তির হতে পারে। স্থানীয় পুলিশের মুখপাত্র মুহাম্মদ বাহার আলী বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত একটি মাত্র লাশ উদ্ধার করতে পেরেছি।’
পুলিশ জানান, উদ্ধার হওয়া মরদেহে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তবে কী ধরনের আঘাতের আলামত মিলেছে, তার বিস্তারিত উল্লেখ করেনি পুলিশ। পুলিশ আরও জানান, গণকবর এলাকা থেকে লোহার শেকল উদ্ধার করেছেন তারা। আর তা থেকে বোঝা যায় মৃত্যুর আগে বন্দিদশায় কেটেছে পাচারের শিকার হওয়া অভিবাসীদের জীবন। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে কাঁটাতার উদ্ধার করা হয়েছে। কাঠ এবং ওই তার দিয়ে ‘মানব খাঁচা’ তৈরি করেছিল পাচারকারীরা।
মালয়েশিয়ার পুলিশ প্রধান খালিদ আবু বাকার বলেন, ‘এসব মানব খাঁচায় অভিবাসীদের বন্দি করে রাখা হতো বলে আমরা ধারণা করছি।’ তিনি বলেন, ‘যেসব দেহাবশেষ পাওয়া গেছে তা আমরা ফরেনসিক বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেছি।’
এদিকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, জাতীয়তা ও মৌলিক মানবিক অধিকারের ব্যাপারে মিয়ানমারকে সাহায্য করার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ডেসমন্ড টুটু। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপের বিরুদ্ধে ইয়ানগুনে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা।
থাইল্যান্ডের উদ্ধার অভিযান শুরু : অভিবাসীদের সহায়তা করার জন্য আন্দামান সাগরে হেলিকপ্টার অবতরণযোগ্য বিশাল জাহাজ পাঠিয়েছে থাইল্যান্ড। জাহাজটিতে হেলিকপ্টার অবতরণের সুবিধার পাশাপাশি প্রায় ৪০০ ক্রুকে বহন করার ক্ষমতা আছে। উদ্ধারের পর অভিবাসীদের জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার সুযোগও আছে জাহাজটিতে। থাকছে অপারেশন রুম এবং দন্ত চিকিৎসকের কক্ষ।
অভিবাসীদের সহায়তায় নৌবাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে বিমান বাহিনীও যেন যুক্ত হতে পারে, সে কারণেই জাহাজটি পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার দেশটির এয়ার চিফ মার্শাল জম রাংসওয়াং বলেন, ‘আমাদের আটটি বিমান দুভাগে উদ্ধার অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ বিমানগুলো ২০০ নটিকাল মাইল (৩৭০ কিলোমিটার) ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে অনুসন্ধান চালাবে।
এর আগে থাই প্রধানমন্ত্রী জেনারেল প্রায়ুথ চান ওঁচা বলেছেন, সমুদ্রে ভাসমান কোনো অভিবাসী নৌকাকে দেখলে নৌবাহিনী সেটিকে এ জাহাজটির কাছে নিয়ে আসবে। অভিবাসীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর তৃতীয় কোনো দেশের (ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া) উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
জাতিসংঘের হিসাব মতে, এখনও প্রায় ২ হাজার ৬শ’র বেশি অভিবাসী বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরে ভাসছেন। এর আগে গত ১০ মে থেকে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় ৩ হাজারের বেশি অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে।
অভিবাসীদের সরকারি ভবনে রাখবে মালয়েশিয়া : বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অভিবাসীদের মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের ভবন ও প্রাঙ্গণে আশ্রয় দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ হামিদি। মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট চত্বরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জাহিদ হামিদি বলেন, পেনাংয়ে বেশ কয়েকটি জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোতে অভিবাসীদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয় শিবির খোলা হয়েছে। একই সঙ্গে রাজ্য সরকারকে তাদের আশ্রয় দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার পেনাং (রাজ্য) সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছে, রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের আশ্রয় দিয়ে প্রমাণ করুক তারা মানবাধিকার রক্ষায় অগ্রগামী।’ এর আগে পেনাং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী লিম গুয়ান ইং অভিবাসীদেও কেন্দ্রের মালিকানাধীন ভূমিতে আশ্রয় দেয়ার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি জানান, তার রাজ্যে জায়গার অভাব।
এদিকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক অভিবাসী সংকট মোকাবেলায় বিশ্ববাসীর সহযোগিতা কামনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটি শুধু মালয়েশিয়ার একার সমস্যা নয়, মানব পাচার এখন সারা বিশ্বের অন্যতম সমস্যা।’

No comments

Powered by Blogger.