তরুণীকে নিয়ে চার জনের হাতাহাতি by সৈয়দ আতিক

গারো জাতিগোষ্ঠীর তরুণী গণধর্ষণের পর চার যুবক নিজেদের মধ্যে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। একজন আরেকজনের গলা টিপে ধরে। এক পর্যায়ে একজনের খুলে রাখা প্যান্টও চলন্ত গাড়ি থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হয়। এ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল ‘উপভোগে’ বৈষম্য নিয়ে।
গণধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার চার যুবক এ তথ্য জানিয়েছে। এরা হলেন- আশরাফ খান ওরফে তুষার, জাহিদুল ইসলাম লাভলু, ফিরোজ ও খোকন। তবে এদের দু’জনকে বুধবার গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে র‌্যাব। সংস্থাটি জানায়, তুষারকে মঙ্গলবার রাতে পটুয়াখালীর কলাপাড়া এবং অন্য তিনজনকে গুলশান থেকে গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাব এ ঘটনায় মাইক্রোবাসটিও জব্দ করেছে। র‌্যাবের সূত্র মতে, মামলার স্বার্থে ফিরোজ ও খোকনের মধ্যে যে কোনো একজনকে সাক্ষী বানানো হতে পারে। সে হিসেবে এ ঘটনায় তিনজন অভিযুক্ত। তরুণীর এ দুর্ঘটনার সুষ্ট বিচার সম্পন্ন করতে র‌্যাব এ আয়োজন করেছে।
এ অপরাধে নেতৃত্ব দেয়া আশরাফ খান ওরফে তুষার দাবি করে, চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ওই তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে সে। তরুণীর কাছ থেকে টাকাও ধার নিয়েছিল। সময় স্বল্পতার কারণে দু’জন ধর্ষণ করতে পারেনি। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়েছিল তাদের। তবে তরুণীর দাবি ছিল পাঁচজন তাকে ধর্ষণ করেছে।
তরুণী গণধর্ষণের ঘটনায় বুধবার র‌্যাব সদরদফতর আনুষ্ঠানিক সংবাদ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ চলন্ত মাইক্রোবাসে তরুণীকে শারীরিক নির্যাতনের বিষয়ে নানা তথ্য দেন।
মুফতি মাহমুদ বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে কুড়িল রোড থেকে তরুণীকে গাড়িতে ওঠিয়ে নির্যাতন করা হয়। এ তথ্য জানার পরপরই র‌্যাব তরুণীর তথ্য অনুযায়ী অভিযানে নামে। এ অভিযানের একপর্যায় ঢাকা ও কুয়াকাটায় অভিযান চালিয়ে ধর্ষকদের গ্রেফতার করা হয়। তিনি বলেন, ঘটনার পরই র‌্যাব প্রযুক্তিগত সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে অপরাধীদের গ্রেফতারে সক্ষম হয়।
তুষার জানায়, মাইক্রোবাসটির সামনে বসা ছিল ফিরোজ। আর সে ছিল মাঝের সিটে। সেখান থেকে পেছনে সিটে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের আগে সিটে বসেই সে তার জিন্সপ্যান্ট খুলে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে। তরুণীকে বিবস্ত্রও করে সে। তুষারের দাবি, এ সময় তরুণী বলে, ‘এটা কী করছেন ভাইয়া। আপনি যদি আমার শরীর নেন। তাহলে আমি আমার স্বামীকে কী দিবো।’
র‌্যাব সূত্র জানায়, তখন তুষার রাগত স্বরে বলে, ‘আগে আমি তারপর স্বামী।’ তখন মেয়েটির সঙ্গে তার ধস্তাধস্তিও হয়। একপর্যায় তুষার তাকে হত্যার ভয় দেখায়। সহযোগীদের বলে, ‘এই ছুরি দাও ওর গলায় চালাই’। তুষার জানায়, তরুণীকে গাড়িতে তুলে এমনটি করবে তা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে সে। নিউমার্কেট থেকে ১৬০ টাকায় থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট কিনে গাড়িতে রাখে।
তুষার আরও জানায়, ঘটনার আধাঘণ্টা আগে কুড়িল রোডের একটি দোকান থেকে কোমলপানীয় কিনে নেয়। চলন্ত গাড়িতে তরুণীকে নির্যাতনের সময় উচ্চস্বরে গান ছেড়ে দেয়। এ সময় গাড়ি চালানোর দায়িত্বে ছিল লাভলু। তুষার লাভলীকে বলে, ‘আমি আগে ফুর্তি করি। পরে তুই। এখন তুই একটা কাজ কর ‘আই আম এ ডিসকো ডেন্সার’ গানটা সাউন্ড দিয়ে বাজা। গাড়িতে গান বাজিয়ে উত্তরা ও কুড়িল ফ্লাইওভার তারা দু’বার ঘুরে। এর ফাঁকে তুষার মেয়েটিকে দু’বার ধর্ষণ করে।
তুষার স্বীকার করেছে, পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে সে যৌনউত্তেজক ট্যাবলেট সেবন করে। তার এ জঘন্য খায়েশ নিবৃত হলে পরে লাভলু তরুণীকে ধর্ষণ করে। তখন গাড়ি চালানোর দায়িত্ব নেয় তুষার। লাভলু জানায়, তরুণীর সঙ্গে সে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানোর সময় ফিরোজ চেয়ে বসে। সে বলে, আর কত সময়। তখন লাভলু ধমক দিয়ে বলে, ‘ব্যাটা ধৈর্য ধর।’ লাভলুর তথ্যমতে, তখন তরুণী বলে, ‘ভাইয়া আপনারা কাজ ভালো করছেন না। আমার কোনো চাকরির দরকার নেই। আমাকে ছেড়ে দেন। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।’ এ সময় লাভলু তরুণীকে বলে, ‘কথা কম বলবি। একদম গলা টিইপ্পা দিমু...(প্রকাশের অযোগ্য)।’
লাভলু ও তুষারের এ অপকর্ম শেষ হলে খোকন বলে, ‘আমি কি বাদ যামু। তখন ফিরোজ বলে আমি কি করব। তুষার বলে, দু’জনে যা করবা দ্রুত। ওরে জসিমউদ্দিন রোডে নামায় দিতে হবে।’ এরপর তাদের মধ্যে শুরু হয় হৈচৈ। পরে তুষার তরুণীকে নিয়ে উত্তরায় বাসার সামনে নামিয়ে দেয়। তখন তরুণী বলে, ‘আপনারা কাজটা ভালো করেননি। এর উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবে।’ তখন দুই যুবক হাসতে থাকে।
তুষার আরও জানায়, সেখান থেকে ফেরার পর তার পরনে তখনও ছোট প্যান্টই ছিল। একপর্যায় খায়েশ মেটাতে না পারা ফিরোজ তার প্যান্ট রাস্তার পাশে চলন্ত গাড়ি থেকে ছুড়ে ফেলে। উভয়ের মাঝে শুরু হয় হাতাহাতি। একপর্যায় তারা কুড়িল এয়ারপোর্ট রোডে এসে নেমে পড়ে। তখন ফিরোজ তুষারকে মারতে যায়। তাকে গাদ্দার ও হারামি বলে আখ্যা দেয়। তুষার জানায়, ছোট প্যান্ট পরে বাসায় যাওয়ার পর তার স্ত্রী বলে এই প্যান্ট কেন? তখন সে নানা কথা বলে স্ত্রীকে বোঝায়।
কে এই তুষার : আশরাফ খান ওরফে তুষার। বয়স ৩৫ বছর। তার পিতার নাম আবদুল মান্নান খান। সে ১৯৮২ সালে বরগুনা জেলার আমতলী থানাধীন চুনাখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। চুনাখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে ৩য় শ্রেণী পাস করে। ১৯৯৯ সালে ঢাকায় এসে ফতুল্লায় ট্রলারে কাজ শুরু করে। এরপর সে ড্রাইভিং শিখে ট্যাক্সি ক্যাব চালায়। ট্যাক্সি ক্যাব চালানোর কিছুদিন পর তার পূর্বপরিচিত ফিরোজের মাধ্যমে গুলশান-১ সিগনেট বাইং হাইসে ড্রাইভার হিসেবে যোগদান করে। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত সে উক্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিল। চাকরির স্বার্থে সে তার বসদের নিয়ে তরুণীর প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটা করতে যায়।
কেনাকাটার সময় তরুণীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে কোথায় চাকরি করে মেয়েটি তা জানতে চায় এবং সে সিগনেট বায়িং হাউসে চাকরি করে বলে মেয়েটিকে জানায়। সবকিছু জেনে মেয়েটি তার অফিসে রিসিপসনে লোক নিয়োগ হবে কিনা, এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চায়। সে মেয়েটিকে ফাঁদে ফেলানোর জন্য পরিকল্পনা করে। তার অফিসে চাকরি দেয়ার কথা বলে মোবাইল নম্বর আদান-প্রদান করে। পরের দিন ১৭ মে সকাল বেলা তরুণীর সঙ্গে মোবাইলে তার কথা হয়। পরবর্তী সময় সে তার পরিচিত ড্রাইভার লাভলু ও ফিরোজের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে। লাবলু ও ফিরোজ তাকে পরামর্শ দেয়, যে কোনো মূল্যে ওই মেয়ের সঙ্গে সবাই মিলে শারীরিক সম্পর্ক করবে।
পরবর্তী সময় ২০ মে উত্তরার জসিমউদ্দিন রোডে তরুণীর সঙ্গে দেখা করে মেয়েটিকে চাকরি দেয়ার কথা বলে তার বায়োডাটা চায়। ২১ মে ডিউটি শেষে মালিকের মাইক্রোবাস ও তার সহযোগী লাভলুকে নিয়ে রাত আনুমানিক সোয়া ৯টার দিকে ঘটিকায় কুড়িল বিশ্বরোডে আসে। সেখানে তরুণীর সঙ্গে তারা দেখা করে এবং মেয়েটির বায়োডাটা নেয়। সে মেয়েটিকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। মেয়েটি প্রথমে রাজি না হলে অনেক অনুরোধ করে গাড়িতে তোলে।
তরুণীর সঙ্গে তুষারের আর্থিক লেনদেনও হয়েছে বলে র‌্যাব কর্মকর্তাদের জানায় সে। তুষার জানায়, পরিচয়ের দুদিন পরই সে তার কাছে ১০ হাজার টাকা ধার চায়। পরে আট হাজার টাকা ধারও দেয়।
কে এ লাভলু : জাহিদুল ইসলাম ওরফে লাভলু। বয়স ২৬ বছর। তার পিতার নাম মোবারক আলী হাওলাদার। ১৯৮৮ সালে ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া থানাধীন তালতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। মানিক চেয়ারম্যান বাড়ির মাদ্রাসা থেকে ৮ম শ্রেণী পাস করে। পরে সংসারে অভাব-অনটনের কারণে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। পরে নানা স্থানে কাজ করে ঢাকায় সিগনেট এন্টারপ্রাইজ লি. কোম্পানির ড্রাইভার হয়। ফিরোজ তাকে তার কোম্পানির ড্রাইভার হিসেবে চাকরি প্রদানের নিমিত্তে পরিচয় করিয়ে দেয়। উক্ত পরিচয়ের সূত্র ধরে সে গত দেড় বছর পূর্বে ঢাকা এসে ওই বায়িং হাউসের এমডি নাজির করিমের গাড়ি চালানো শুরু করে।
তার অফিসের ড্রাইভার আশরাফ খান তুষার উক্ত কোম্পানির মাইক্রোবাস চালাত এবং ফিরোজ প্রাইভেট কার চালাত। ১৬ মে ড্রাইভার আশরাফ ফিরোজকে বলে একটা মেয়ের মোবাইল নম্বর নিয়ে এসেছি। তাকে গাড়িতে উঠিয়ে ধর্ষণ করা হবে। উক্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী ড্রাইভার আশরাফ গাড়ি নিয়ে কুড়িলে কর্মস্থলের সামনে আসে।
র‌্যাব সদরদফতরে বুধবার র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান যুগান্তরকে বলেন, ফিরোজ ও খোকন তাদের অপকর্মের পূর্ণ খায়েশ মেটাতে না পেরে তুষার ও লাভলুর ওপর ক্ষিপ্ত হয়। তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তারা বলেন, উভয়ের মাঝে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তারা জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানায়। অভিযানে দিকনির্দেশনা ও প্রযুক্তিগত গবেষণায় নিয়োজিত থাকা র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতারের পরপরই র‌্যাবের পক্ষে তরুণীকে এ তথ্য জানানো হয়। পরে তরুণী র‌্যাবের কর্মকর্তাদের কাছে তার পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
চারজনের মধ্যে র‌্যাব দুজনকে ভাটারা থানায় হস্তান্তর করেছে। র‌্যাব বলছে, ঠিক কতজন জড়িত আছে তা তদন্ত শেষে বলা যাবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, বুধবার তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.