সাংসদদের ‘জ্ঞানের’ আকাঙ্ক্ষা by এ কে এম জাকারিয়া

প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া মানেই কোনো বিষয়ে কিছু ‘জ্ঞান-বুদ্ধি’ অর্জন করা। পদ্মা সেতু একটি বড় ব্যাপার। এত বড় প্রকল্প এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। এ জন্য নানা পর্যায়ে জ্ঞান-বুদ্ধি অর্জন জরুরি বৈকি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাজেটে সে কারণেই একটি প্রশিক্ষণ খাত রয়েছে। ভাগ্যিস এমন একটি খাত ছিল, তা না হলে আমরা কী করে টের পেতাম যে বড় সেতু প্রকল্প বিষয়ে জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা আমাদের ছয় সাংসদের মধ্যে এতটা প্রবল!
জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা ও তা অর্জন সব সময়ই মহৎ কাজ। আর এ জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাওয়ার কথা তো ধর্মীয়ভাবেই বলা আছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমাদের ছয় সাংসদ এরই মধ্যে চীন চলে গেছেন। চারজন আবার স্ত্রীকেও নিয়ে গেছেন। শুধু নিজের ‘জ্ঞান অর্জন’ নিয়ে তাঁরা নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট থাকতে চাননি! নিজের গাঁটের পয়সা খরচ (স্ত্রীদের খরচ নিজেদেরই বহন করতে হবে) করে তাঁরা স্ত্রীদের বিষয়টিও নিশ্চিত করেছেন। সাংসদেরা যখন যাবেন তখন তাঁদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা বা তাঁদের দেখভালের জন্য সরকারের কর্মকর্তারাও যাবেন, এটাই স্বাভাবিক। হয়েছেও তা-ই। ছয় সাংসদের চীন সফরের পুরো দলটি হচ্ছে ১৩ জনের। পদ্মা সেতুর ‘প্রশিক্ষণ খাত’ থেকে এ জন্য ‘আনুষ্ঠানিক’ খরচ ৪১ লাখ টাকা মাত্র। ‘অনানুষ্ঠানিক’ খরচ বলেও তবে নিশ্চয়ই কিছু আছে!
পদ্মা সেতুর কাজ পেয়েছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। চীনে তৈরি করা নানা অবকাঠামো তাদের রয়েছে। সাংসদদের এ সফরের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এ ধরনের বিভিন্ন অবকাঠামো পরিদর্শন করা। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, ‘সাংসদেরা সেখানে চীনের বিভিন্ন শহরে ঘুরছেন। থাকছেন দামি হোটেলে। যাতায়াতের জন্য গাড়ি ও গাইড সরবরাহ করা হয়েছে।...সরকারিভাবে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তা দিয়ে সফর সম্পন্ন করা যাবে না। বাড়তি ব্যয় প্রয়োজন হতে পারে এবং তা ঠিকাদারের কাছ থেকে নেওয়া হবে।’ (প্রথম আলো, ২৭ মে)। সফরটির ধরন সম্পর্কে প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে আমরা একটি ধারণা পেলাম। বুঝলাম, ‘অনানুষ্ঠানিক’ খরচ বিষয়টি কী এবং কোথা থেকে তা আসবে।
এ যুগে কোনো কিছুই ফ্রি নয়, ‘জ্ঞান’ অর্জনও নয়। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক নানা পথে খরচ করেও যদি তা অর্জন করা যায়, তাতেই নাহয় সই। কিন্তু কৌতূহলী মনে নানা প্রশ্ন জাগে। বড় বড় সেতু দেখার এসব ‘অবকাঠামো পরিদর্শনকে’ আমাদের ‘প্রশিক্ষণ’ হিসেবে ধরে নিতে হবে? আর এসব দেখে তাঁরা যে ‘জ্ঞান অর্জন’ করবেন, তা পদ্মা সেতুর কী কাজে লাগবে? সেতু বানানো, এর কাঠামো—এগুলো সবই কারিগরি বিষয়। সিভিল কনস্ট্রাকশন বিষয়ে যাঁর ধারণা নেই, তিনি সেতু দেখে কী বুঝবেন? অথবা এই সাংসদেরা এর খরচ সম্পর্কেই বা কী ধারণা করবেন?
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথায় অবশ্য বোঝা গেছে যে এটা আসলে প্রশিক্ষণ নয়, ভ্রমণ। ‘সব মন্ত্রণালয়েই সংসদীয় কমিটির সদস্যদের ভ্রমণের রেওয়াজ আছে।’ আমরা বুঝলাম সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এই ‘রেওয়াজ’ তামিল করেছে পদ্মা সেতুর ‘প্রশিক্ষণ খাতের’ টাকায়। তবে তঁার মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্যদের এমন একটি ‘ভ্রমণ’-এর ব্যাপারে তিনি নাকি রাজিও ছিলেন না। সাংসদদের ‘পীড়াপীড়িতে’ তঁাকে রাজি হতে হয়েছে। যে সাংসদেরা মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীকে জবাবদিহির মধ্যে রাখবেন, তাঁরা মন্ত্রীর কাছে ‘পীড়াপীড়ি’ করেন বিদেশ ভ্রমণের জন্য! সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী আর কীই বা করবেন, এঁদের হাতে না রাখলেও যে তাঁর বিপদ। এই মন্ত্রণালয় আর এর মন্ত্রীকে এখন সংসদীয় কমিটি আগলে রাখবে বলেই তো মনে হয়।
সাংসদদের এ সফরের বাড়তি কোনো খরচ ঠিকাদারের কাছ থেকে নেওয়া হবে না বলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী দাবি করেছেন। কিন্তু দামি দামি হোটেলে থাকা, গাড়ি ও গাইড—এসব যে ‘আনুষ্ঠানিক’ খরচে সামলানো যাবে না, তা অনুমান করা যায়। বাড়তি খরচ তবে কোথা থেকে আসবে? এই ধোঁয়াশা যে কোনোভাবেই কাটছে না। জানতে ইচ্ছা হয়, চীনে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির কাজ দেখতে গিয়ে তাদের আতিথ্য নেওয়া থেকে কি শতভাগ দূরে থাকতে পারবেন আমাদের সংসদীয় কমিটির সদস্যরা? অথবা অন্য কোনো সুযোগ–সুবিধা নেওয়া থেকে? ভরসা করা খুব কঠিন। ভবিষ্যতে পদ্মা সেতুর মূল নির্মাণকাজের দায়িত্ব পাওয়া এই প্রতিষ্ঠানটিকে কোনো কারণে যদি জবাবদিহির আওতায় আনতে হয়, তখন সংসদীয় কমিটি তা করার জোর নৈতিকভাবে কতটা পাবে?
পদ্মা সেতু বানাতে খরচের যে হিসাব করা হয়েছে, তা দফায় দফায় বেড়েছে। অনেক সময় যৌক্তিক কারণেই তা বাড়ে। তবে বাংলাদেশে কাজ করতে গিয়ে চীনা কোম্পানিগুলো মাঝপথে কাজ বন্ধ করে ব্যয় বাড়াতে চাপ দিয়েছে বা ব্যয় বাড়িয়ে নিয়েছে এমন নজির আছে। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে এমন ঘটবে না তা কি হলফ করে বলা যায়? চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ভবিষ্যতে কোনো কারণে পদ্মা সেতুর খরচ বাড়াতে চাইলে তখন অনেকের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে না তো!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.