বাংলাদেশের সূচনায় ছিল মুসলিম লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব by প্রণব মুখার্জি

সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জির বই ‘দি ড্রামেটিক ডিকেড দি ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স প্রকাশ করেছে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স। এ বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধ: দি মেকিং অব বাংলাদেশ’-এর অবিকল তরজমা...
(তৃতীয় কিস্তি)
বাস্তবতাও আসলে অবিভক্ত বাংলার প্রবক্তাদের কাজ দুরূহ করে দিয়েছিল। কলকাতা ও নোয়াখালীর দাঙ্গার পরে হিন্দুরা একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে বাস করার ব্যাপারে চিন্তিত ও দ্বিধান্বিত হলো, আর অবিভক্ত বাংলার ক্ষেত্রেও তাদের ভাবনা দাঁড়ালো তাই। নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার সভাপতি ও বাংলার একজন বিশিষ্ট নেতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি একটি বিভক্ত বাংলার শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন এবং তিনি জনমতকে বহুলাংশে তাঁর মতের অনুকূলে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে তিনি বাঙালি হিন্দুদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এই প্রেক্ষাপটে গভর্নর জেনারেল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ঐকমত্য ছাড়া কোন নতুন স্কিম বিবেচনা করতে অস্বীকৃতি জানান।
এদিকে সোহরাওয়ার্দীর জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পেল। কারণ তখন একটি অবিভক্ত বাংলার প্রতি তার সমর্থন ও শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষকতার কারণে প্রায় নিয়মিতভাবে বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে থাকলো। আর অজুহাত খাড়া করা হলো যে, তিনি এমন একটি এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, সেটা এখন পশ্চিমবঙ্গে পড়েছে। আর তাই পূর্ববঙ্গ অ্যাসেম্বলিতে ঢাকার নওয়াব খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে তিনি মুসলিম লীগ নেতার আসন হারিয়েছেন, খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দিয়েছেন যে ঢাকা হবে পূর্ববঙ্গের রাজধানী। মুজিবুর রহমান তাঁর স্মৃতিকথায় দাবি করেছেন যে, এটা করার ফলে খাজা নাজিমুদ্দিন কলকাতাকে পাকিস্তানের রাজধানী ঘোষণার সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন। তাঁর মতে কলকাতা যদি পূর্ববঙ্গের অংশে পরিণত হতো, তাহলে এটা অবশ্যই পাকিস্তানের রাজধানী হতো। তিনি আরও দাবি করেছেন যে, বাংলার মুসলিম জনগণের মধ্যে সোহরাওয়ার্দীর সার্বিক জনপ্রিয়তা হয়তো তাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আসনে নিয়ে গেছে।  
বাংলাদেশের প্রারম্ভিক-বিন্দু মুসলিম লীগের মধ্যেকার অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং এইচ. এস. সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক ও আবুল হাশিমের মতো অনেক বিশিষ্ট নেতাকে কোণঠাসা করার বিরোধের মধ্যে নিহিত থেকেছে। দেশভাগের পরে পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগ প্রধানত জমিদার ও ভূস্বামী অভিজাতদের কর্তৃত্বে থেকেছে। মুজিবুর রহমান তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদের অন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া পূর্ব বাংলায় নেতৃত্ব নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণ। কারণ লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির একটি বড় অংশ জমিদার ছিলেন। এমনকি মুজিবুর রহমান যখন সিলেটের নবনির্বাচিত সদস্যদের ওপর সোহরাওয়ার্দীর সমর্থনে প্রভাব বিস্তার করতে চাইলেন, তখন তিনি ব্যর্থ হলেন। বলা হয়ে থাকে যে, তারা (জমিদার-রাজনীতিক) যখন নেতৃত্ব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন, তখন তারা সোহরাওয়ার্দীর কাছে মন্ত্রিসভায় তিনটি পদ এবং সেই সঙ্গে জমিদারি প্রথা বিলোপ না করার ব্যাপারে তাঁর কাছে প্রতিশ্রুতি দাবি করলেন।  সোহরাওয়ার্দী কোন অঙ্গীকার করতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং তারা তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দিলেন।
জাতীয় রাজনীতিতেও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটলো। এরফলে পূর্ববাংলার রাজনীতিকরা আরও বেশি প্রান্তিক অবস্থায় পৌঁছে গেলেন। ১৯৪৯ সালে জিন্নাহ মারা গেলেন এবং ১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খানের হত্যাকাণ্ডের পরে খাজা নাজিম উদ্দিন প্রথমে পাকিস্তানের  গভর্নর জেনারেল ও পরে প্রধানমন্ত্রী হলেন। নাজিম উদ্দিন প্রধানমন্ত্রী (যদিও কয়েক বছর পরে তাঁর জায়গায় বগুড়ার মোহাম্মদ আলী এসেছিলেন) হওয়ার কারণে গোলাম মোহাম্মদ, যিনি একজন পাবলিক সার্ভেন্ট, তিনি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন। গোলাম মোহাম্মদের নিয়োগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি রাজনীতিতে আমলাতন্ত্রের অভিষেক ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের প্রকৃত শাসক ছিলেন সিভিল সার্ভেন্ট, সামরিক বাহিনী এবং ভূস্বামী অভিজাতরা। তাদের সঙ্গে শিল্পপতিদের একটি গোষ্ঠী ছিল, তারা সবাই মিলে বিরাট একটা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। আর মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নাজিমুদ্দিন ও মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মতো কতিপয় পূর্ব পাকিস্তানি নেতাদেরকে সামনের সারিতে রেখেছিলেন। এর লক্ষ্য ছিল তাদেরকে শোকেস হিসেবে ব্যবহার করা। যাতে এটা দেখানো যায়, পূর্ব পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ সামগ্রিক পাকিস্তানি এস্টাবলিশমেন্টের মধ্যে অংশগ্রহণকারী হিসেবে রয়েছেন। কিন্তু তাঁরা প্রকৃত শাসকদের পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলেন।
পূর্ববঙ্গে সরকার গঠনের পরে পূর্ববঙ্গের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসী হয়ে যান। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের থেকে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ পূর্ববঙ্গে চলে যান। আর সরকারের মতো মুসলিম লীগের নেতৃত্বেও একই ঘটনা ঘটলো। মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী,  ১৯৩০-এর দশকে যাদের উত্থান ঘটেছিল, তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হলেন। আর এর ফল হিসেবে ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে মুসলিম লীগ তার চড়া মূল্য দিলো।
ইতিমধ্যে রাষ্ট্রভাষা অন্দোলন বেগবান হলো। জিন্নাহসহ মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ একরোখা হলেন যে, উর্দুকেই তারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করবেন। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের গণপরিষদে বিষয়টি আলোচিত হয়। গণপরিষদ কংগ্রেস দলীয় অন্যতম সংসদ সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত দাবি তুললেন যে, বাংলাকে অনুত্যম জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তিনি যুক্তি দিলেন যে, বাংলা হলো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা। তাঁর এই দাবি মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ দ্বারা বিপুলভাবে সমালোচিত হলো। এবং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য ভারতীয় চর হিসেবে কাজ করার জন্য দত্তকে অভিযুক্ত করলেন। কিন্তু এই সমালোচনা সত্ত্বেও বাংলায় এর প্রতিক্রিয়া হলো দ্ব্যর্থহীন। পূর্ববঙ্গ মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ এবং তমুদ্দিন মজলিশ (একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন) উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার প্রতিবাদে সোচ্চার হলো এবং তারা দত্তের দাবি পুনর্ব্যক্ত করলো। কামারুদ্দিন আহমেদ, শামসুল হকের মতো  জ্যেষ্ঠ মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এবং মুজিবুর রহমান তাঁরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করলেন এবং ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চে বাংলাভাষা দিবস পালন করলেন।
একটি পুলিশ ও প্রশাসনিক ক্রাকডাউনের বিরুদ্ধে  ব্যাপকভিত্তিক ছাত্র সমর্থন এবং সমাবেশ গড়ে উঠলো। প্রতিবাদকারী ছাত্রনেতা কর্মীদের নির্দয়ভাবে প্রহার করা হলো। অনেকে গ্রেপ্তার হলেন। তখন পূর্ববঙ্গের অ্যাসেম্বলি অধিবেশনরত ছিল, সেখানে ফজলুল হক, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, তফাজ্জল আলী, খয়রাত হোসেন এবং অনোয়ারা খাতুন সহ অনেকেই মুসলিম লীগ ও সরকারের কঠোর নিন্দা করলেন। সরকারি নিপীড়নের ফলে ঘটনার ওপর ব্যাপকভিত্তিক জনসমর্থনের ভিত্তি গড়ে উঠলো এবং সরকার প্রতিবাদরত ছাত্রদের সঙ্গে একটি সংলাপে বসতে রাজি হলো। কিন্তু এর অল্প পরেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহকে ঢাকায় স্বাগত জানাতে আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করা হলো।
২৪শে মার্চ জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দিলেন এবং সেখানে তিনি ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা’ পুনর্ব্যক্ত করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। আর উভয় ক্ষেত্রে ছাত্ররা উচ্চস্বরে ও পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলো- ‘না, আমরা তা মানি না।’
জিন্নাহর ঢাকা ঘোষণা কেবল প্রতিবাদকেই শক্তিশালী করেছিল। এবং ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এটি দাঙ্গার মতো মারাত্মক ঘটনায় মোড় নিলো। বিপুল সংখ্যক ছাত্রকে প্রহার বা কারাগারে প্রেরণ করা হলো, এমনকি অনেককে হত্যা করা হলো। ভাষা আন্দোলনের প্রভাব এবং মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ দ্বারা সেই আন্দোলন অদক্ষভাবে মোকাবিলা করায় সক্রিয় বাঙালি উপ- জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘটলো।
ভাষা আন্দোলন যখন পর্যায়ক্রমে  বেগবান হলো, তখন মুসলিম লীগের মধ্যে গণ্ডগোল ছড়িয়ে পড়লো। ১৯৪৭ সালে নাজিমউদ্দিন তার মন্ত্রিসভায় সোহরাওয়ার্দীর কোন লোককেই ঠাঁই দেননি। এবং এর ফলে সোহরাওয়ার্দীর সমর্থকরা ঐক্যবদ্ধ হলেন এবং মোহাম্মদ আলী বগুড়া, ড. আবদুল মালেক, তোফাজ্জল আলী এবং মুসলিম লীগের একটি বড় অংশ মিলে গঠন করলো একটি প্রেশার  গ্রুপ। এবং যখন ওই অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করলো, তখন মাওলানা আকরাম খান কতিপয় পুরনো মুসলিম লীগ কাউন্সিল সদস্যদের দল থেকে বহিষ্কার করলেন। এভাবে যারা একতরফা বহিষ্কারের শিকার  হলেন তারা নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতির কাছে নালিশ দিলেন এবং সভাপতি হিসেবে চৌধুরী খলিকুজ্জমান পরিষ্কার ভাষায় তাদের জানিয়ে দিলেন যে, তাদেরকে অবশ্যই খাজা নাজিম উদ্দিনের অধীনে কাজ করতে হবে এবং আকরাম খানই সিদ্ধান্ত নেবেন, কে দলে থাকবে বা কাদের থাকা উচিত।
এইসব ঘটনার প্রেক্ষাপটেই গঠিত হয়েছিল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৪৯ সালে মূলত সোহরাওয়ার্দীর অনুসারীরাই এই দল গঠনের নিয়ামক শক্তি ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট মুসলিম লীগ নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হলেন প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনিই এই দায়িত্বে ছিলেন, এরপর তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করলেন। মুজিবুর রহমান গোড়া থেকেই এই দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এবং দলটি প্রতিষ্ঠায় কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন এবং পূর্ব বাংলায় দলটির প্রভাব তিনি ছড়িয়ে দিলেন। মুসলিম লীগ থেকে বিশিষ্ট এবং জনপ্রিয় নেতাদের দলে দলে বেরিয়ে আসার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ল। পরের বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হিসেবে বেড়ে উঠতে লাগল এবং মুজিবুর রহমান সময়ের ধারায় এই সংগঠনের মুকুটহীন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন।
(সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জির বই ‘দি ড্রামেটিক ডিকেড দি ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স প্রকাশ করেছে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স। এ বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধ: দি মেকিং অব বাংলাদেশ’-এর অবিকল তরজমা) 

No comments

Powered by Blogger.