লাশ কাটা ঘরেও বেআব্রু নারী by শিপন হাবীব

পোস্টমর্টেম করে পুরুষ ডাক্তার ও সহকারীরা * স্বজনরা ভোগেন মর্মপীড়ায় * মহিলারা এগিয়ে আসছেন না এ দায়িত্ব পালনে
দেশে খুন, আত্মহত্যাসহ নানাভাবে প্রতিনিয়তই অপমৃত্যু ঘটছে বহু নারী ও মেয়ে শিশুর। নিয়ম অনুযায়ী তাদের মরদেহ পোস্টমর্টেমও করা হচ্ছে। কিন্তু লাশ কাটা ঘরে নারীদেহ কাটা-ছেঁড়ার স্পর্শকাতর এই কাজটা করে যাচ্ছেন পুরুষ ডাক্তার ও পুরুষ মর্গের সহকারীরা। ডাক্তার বা মর্গ সহকারী হিসেবে মহিলাদের এ দায়িত্বে আসতে দেখা যাচ্ছে না। দেশের ২৯টি মেডিকেল কলেজ ও ৬৪ জেলায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে শুধু পুরুষ ডাক্তার ও পুরুষ মর্গ সহকারীরাই দিনের পর দিন নারী ও মেয়ে শিশুদের মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করে যাচ্ছেন।
ভুক্তভোগী অনেক পরিবারেরই আক্ষেপ, পারিবারিক সহিংসতা বা দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছাড়াও নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় অনেক নারী ও মেয়ে শিশু। মৃত্যুর পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ময়নাতদন্তের টেবিলে। যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সবটুকুই সম্পন্ন করেন পুরুষ ডাক্তার ও পুরুষ মর্গ সহকারীরা। সব ধর্মের মানুষের ক্ষেত্রেই এটি অনৈতিক ও সম্মানহানিকর। ভয়ানক মর্মপীড়ায় আক্রান্ত এসব পরিবারের পক্ষ থেকে দ্রুত মহিলা ডাক্তার ও মর্গ সহকারী নিয়োগ দেয়ার দাবি তোলা হলেও নানা কারণে তার বাস্তবায়ন ঘটছে না।
অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতাল বাদ দিয়ে অধিকাংশ মেডিকেল কলেজ ও সরকারি হাসপাতালের মর্গ সহকারীরা মদ্যপ অবস্থায় নারী ও মেয়ে শিশুদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটা- ছেঁড়ার কাজটি করে থাকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আমাদের সমাজে তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই মৃত মানুষের যথাযথ সম্মান ও অধিকার রক্ষার বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া হয়। তিনি বলেন, দেশে প্রায়ই নারী ও মেয়ে শিশুদের নানা নির্যাতন ও ধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। মেয়েদের নানা কৌশলে যৌন হয়রানি করা হচ্ছে। এসব সহ্য করতে না পেরে অনেক মেয়েই আত্মহত্যা করছে। তাদের পোস্টমর্টেমের নামে যে ধরনের কর্মকাণ্ড হয় তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। একজন জীবিত মানুষের যে ধরনের সম্মান, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মানবাধিকার রয়েছে তার চেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত মানুষের সম্মান ও গোপনীয়তা আরও বেশি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব সরকার এ বিষয়ে মহিলা ডাক্তার ও মহিলা মর্গ সহকারী নিয়োগের ব্যবস্থা করবে, এমনটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
অ্যাডভোকেট সালমা আলী আরও বলেন, ধর্ষণের শিকার নারী ও মেয়ে শিশুদেরও এক সময় পুরুষ ডাক্তাররাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। পরে সচেতন মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ ও দাবির মুখে আদালতের নির্দেশে এখন মহিলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে ‘রেপ ভিকটিম’ নারী ও মেয়ে শিশুদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হচ্ছে। এমনটা পোস্টমর্টেমের ক্ষেত্রেও হওয়া জরুরি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ যুগান্তরকে জানান, মর্গ সহকারী পদের নিয়োগে নারী-পুরুষ বলে কিছু নেই। পুরুষ, মহিলা উভয়ই নিয়োগে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। মহিলারা এ পেশায় আসতে চান না কেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দেশে প্রায় ৩০০ ফরেনসিক মেডিসিন ডাক্তার প্রয়োজন, সেখানে বর্তমানে আছেন মাত্র ২৫/৩০ জন। সারা দেশে শুধু একজন ফরেনসিক মেডিসিন প্রফেসর রয়েছেন। তিনি আরও বলেন, নারী ও মেয়ে শিশুদের পোস্টমর্টেম পুরুষ ডাক্তার ও পুরুষ মর্গ সহকারীরাই করছেন। ঢাকা মেডিকেল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ১ জন করে মোট দু’জন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ মহিলা ডাক্তার থাকলেও তারা শুধু রেপ ভিকটিমদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। পোস্টমর্টেম করছেন শুধুই পুরুষ ডাক্তার ও মর্গ সহকারীরা।
নারী ও মেয়ে শিশুদের পোস্টমর্টেম পুরুষরা করছেন, এমনটা সত্যিই ভালো দেখায় না জানিয়ে ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, বাধ্য হয়েই এমনটা করতে হচ্ছে। মহিলা ডাক্তার ও মর্গ সহকারী না থাকাই এ অবস্থার কারণ। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থাকলেও জেলা হাসপাতালগুলোতে কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। এ পেশায় মহিলা ডাক্তার কিংবা মহিলা মর্গ সহকারী আসছেন না কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ পেশায় পুরুষ ডাক্তাররাই যে থাকছেন এটাই ভাগ্যের বিষয়। একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে সপ্তাহে প্রায় ৩/৪ দিন কোর্টে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে হয়। এর জন্য তাদেরকে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রিপোর্ট কারও না কারও বিপক্ষে যেতেই পারে, আর তখনই হুমকি-ধমকি আসতে শুরু করে। তার ওপর রাজনৈতিক, সামাজিক চাপ তো রয়েছেই।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল, মিটফোর্ড ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সরেজমিন ঘুরে ও সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তার ও মর্গ সহকারীদের সব সময় ভয়ভীতি আর আতংকের মধ্যে থাকতে হয়। বিশেষ করে খুন-খারাপি, নির্যাতনের ঘনটনায় যেসব নারী ও মেয়ে শিশুর লাশ আসে তাদের পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে যথাযথ রিপোর্ট প্রদান করার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। যথাযথ রিপোর্ট দিতে গিয়ে কোনো না কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে সেই রিপোর্ট চলে যায়। তখনই নানা হুমকি আসতে শুরু করে। এমন চাপের কারণেই মূলত এ বিভাগে মহিলা ডাক্তার ও মহিলা মর্গ সহকারী আসতে চাচ্ছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ডাক্তার জানান, সমাজে যে কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের বেশ কদর থাকলেও ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তারদের তেমন কদর নেই। তাদের ‘মরা ডাক্তার’ হিসেবে পরিবার তথা সমাজ মনে করে। তাদেরকে মরা মানুষের ডাক্তার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাছাড়া অন্যসব ডাক্তারের মতো ফরেনসিক ডাক্তাররা প্রাইভেট চিকিৎসাও করতে পারেন না। এসব সমস্যার কারণে ফরেনসিক বিভাগে বিশেষ করে মহিলা ডাক্তাররা আসতে চান না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ফরেনসিক বিভাগে মহিলা ডাক্তারদের না আসাটা সম্পূর্ণ দায়িত্বহীন আচরণ। দেশে সার্জারির অনেক ডাক্তার রয়েছেন। জীবিত নারী ও মেয়ে শিশুদের সার্জারি করার চেয়ে মৃতদেহে পোস্টমর্টেম করা বরং অনেক সহজ। শুধু বাইরে চেম্বার বসিয়ে এক্সট্রা ইনকাম করতে পারবে না বলেই মহিলারা ফরেনসিক বিভাগে আসতে চান না। একই অবস্থা পুরুষদের বেলায়ও। ওই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলেন, সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যেই ফরেনসি বিভাগে মহিলা ডাক্তার ও মহিলা মর্গ সহকারী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। তাতে মৃত নারী ও মেয়ে শিশুর সম্মান এবং অধিকার রক্ষা হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বুধবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে জানান, বছরের পর বছর এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজ চলে আসছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে মহিলা ডাক্তার ও মহিলা মর্গ সহকারী না থাকাটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দফতরের উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতাও বটে। মহিলা ডাক্তার যারা হচ্ছেন তারা তো কাটা-ছেঁড়া দেখে দেখেই ডাক্তারের সার্টিফিকেট অর্জন করছেন। তাহলে মহিলারা কেন ফরেনসিক বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে চাচ্ছেন না, সরকারই বা কেন এ নিয়ে উদাসীন? তিনি আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে অধিক বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ফরেনসিক বিভাগে মহিলা ডাক্তার ও মহিলা মর্গ সহকারী নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে সরকার।
এদিকে দেশের কোনো জেলা সরকারি হাসপাতালেরই ফরেনসিক বিভাগে মহিলা ডাক্তার, মহিলা মর্গ সহকারী না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) অধ্যাপক ডা. শামি-উল-ইসলাম যুগান্তরকে জানান, অনেকবার উদ্যোগ নেয়ার পরও ফরেনসিক বিভাগের এ কাজে মহিলা ডাক্তার ও মহিলা মর্গ সহকারী পদে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে তিনি জানান, এ বিভাগে মহিলাদের নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা চালানো হবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সচিব মো. মঞ্জুরুল ইসলাম এ বিষয়ে বুধবার যুগান্তরকে জানান, নারী ও মেয়ে শিশুদের পোস্টমর্টেম মহিলা ডাক্তার ও মহিলা মর্গ সহকারী করবে- এটা অনেকেরই দাবি। ফরেনসিক বিভাগে মহিলা ডাক্তার ও মহিলা মর্গ সহকারী নিয়োগে কোনো রকম বাধা নেই জানিয়ে তিনি এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

No comments

Powered by Blogger.