মানব পাচারের নেপথ্যে মালয়েশীয় পুলিশ!

মালয়েশিয়ার জঙ্গলের গণকবর থেকে মানুষের
দেহাবশেষ নিয়ে আসছে ফরেনসিক পুলিশ-রয়টার্স
মালয়েশিয়ার পেরলিসের জঙ্গলে গণকবর ও মানব পাচারের নেপথ্যে জড়িত সন্দেহে মালয়েশিয়ার ১২ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। বুধবার মালয়েশিয়ান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ান জুনাইদি সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন। এ ঘটনায় বন বিভাগের কোনো কর্মকর্তা জড়িত আছেন কিনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি। এছাড়া গণকবরের বিষয়টি নিয়ে দেশটির পার্লামেন্টে জরুরি বিতর্ক প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। ওই জঙ্গলের পাশের ওয়াং কেলিয়ান গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, পুলিশ গত কয়েক বছর ধরে এলাকায় ছন্নছাড়া আহত অভিবাসীদের ঘোরাঘুরি সম্পর্কে জানত। কিন্তু তারা মানব পাচারকারীদের মুখোশ খুলছে না। এদিকে অভিবাসী সংকটের শিকার ১০ হাজার মানুষকে উদ্ধার, পুনর্বাসন ও প্রত্যাবাসনের জন্য ২৬ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তারও আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম। খবর এএফপি, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের।
মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় পেরলিস প্রদেশের বুকিত ওয়াং বার্মার জঙ্গলে মানব পাচারকারীদের ২৮টি বন্দিশিবির ও ১৩৯টি গণকবরের সন্ধান পায় দেশটির পুলিশ। ইতোমধ্যে ওই গণকবর থেকে একটি মৃতদেহ ও বহু দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। পরে তা ফরেনসিক বিভাগে হস্তান্তর করা হয়। মানব পাচারে মালয়েশিয়ার পাচারকারীরা এমনকি দেশটির প্রশাসনের কর্মকর্তারা জড়িত বলে গণমাধ্যমে খবর বের হলে নড়েচড়ে বসেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এরই সূত্র ধরে ১২ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ৪ কর্মকর্তাকে গত বছরের শুরুর দিকে গ্রেফতার করা হয়।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ান জুনাইদি বলেন, ‘ওই চারজনকে উত্তরাঞ্চলীয় পেরলিস থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাই আমরা অনুসন্ধান করে দেখছি তাদের সঙ্গে মানব পাচারের কোনো যোগসাজশ আছে কিনা।’ তবে এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি।
তবে নাম প্রকাশ না করে এক কর্মকর্তা বলেন, মানব পাচারকারীদের বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েই তাদের বিরদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
পুলিশ বহু আগে থেকেই জানত : এদিকে ওই জঙ্গলের পাশের ওয়াং কেলিয়ান গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশ বহু আগে থেকেই মানব পাচারের বিষটি জানত। তারা ইচ্ছা করেই তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়নি। কারণ এতে তারাও জড়িত থাকতে পারে।
বাসিন্দারা জানান, জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝেই পাচারের শিকার আহত, অসুস্থ ছন্নছাড়া অভিবাসীরা লোকালয়ে উদয় হতো। গ্রামবাসীরা তাদের খাবার, জামা-কাপড় দিয়ে বিদায় করে দিত। তাদের অনেকে এত দুর্বল থাকতেন যে, কথাও বলতে পারতেন না।
কেলিয়ান গ্রামের বাসিন্দা সানি হাশিম বলেন, ‘আমি এখানে ৩০ বছর ধরে বসবাস করছি। আমি প্রায়ই রোহিঙ্গা অভিবাসীদের দেখতাম। আমরা তাদের জন্য যা পারতাম তাই করতাম। তারা যদি দাঁড়াতে বা হাঁটতে না পারত আমরা তখন বিষয়টি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানাতাম। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি তারা।’
অধিবাসী লিজা ইব্রাহিম বলেন, ‘তারা আমার দোকানে এসেছিল। তারা এত দুর্বল ছিল যে কথা বলতে পারছিল না। তাদের হাত-পায়ে আঘাতে চিহ্ন ছিল। তারা তা ঢেকে রেখেছিল।’
ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে আমরা এমন অভিবাসী দেখে আসছিলাম। অভিবাসীদের সবচেয়ে বড় যে দলটি আমি দেখি তারা ছিল ১০ জন। সেখানে শিশুও ছিল।’
৫৫ বছর বয়সী ওই ব্যবসায়ী জানান, তিনি এমন বেশ কয়েকজন অভিবাসীকে খাবার ও কাপড় দেন। তিনি বলেন, ‘এটা এখানকার একটা স্বাভাবিক দৃশ্য ছিল। আমরা এটা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। কারণ আমরা ভাবতাম, তারা থাইল্যান্ড থেকে এসেছে কিন্তু এখন গণকবরের সন্ধানের পর আমরা খুবই মর্মাহত হয়েছি।’
২৬ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তার আবেদন : মানব পাচারের শিকার কয়েক হাজার বাংলাদেশী নাগরিক ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা এখনও বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরে নিখোঁজ আছে। এ তথ্য জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম। একইসঙ্গে অভিবাসী সংকটের শিকার ১০ হাজার মানুষকে উদ্ধার, পুনর্বাসন ও প্রত্যাবাসনের জন্য ২৬ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তারও আবেদন জানিয়েছে সংস্থা দুটো।
বুধবার ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ আবেদন জানানো হয়। ফিলিপাইনে নিয়োজিত ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি বার্নার্ড কারব্লাট জানান, অন্তত ২,৬২১ অভিবাসী এখনও সাগরে ছোট্ট নৌকায় ভাসমান আছে বলে ধারণা করছেন তারা। এদের অনেকে মালয়েশিয়া উপকূলের কাছে, আবার অনেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কাছে ভাসমান থাকতে পারে বলেও জানান তিনি। তবে ইউএনএইচসিআরের ধারণাকৃত সংখ্যার চেয়ে সাগরে ভাসমানদের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে আশংকা জানান বার্নার্ড।
তিনি বলেন, ‘প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় সাগরে ভাসমানদের উদ্ধার করা জরুরি। বলতে গেলে এখনও সাগরে খাবার-পানি ছাড়া নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে অনেক মানুষ সাগরে ভাসমান অবস্থায় মানবেতর দিন যাপন করছে। তাদের তীরে নিয়ে আসাটা জরুরি।’
বার্নার্ড জানান, ‘ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড উপকূল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত তিন হাজার ৩০০শ’ অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে। আরও ১ হাজারেরও বেশি মানুষকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে সাগরে নতুন কোনো অভিবাসীবাহী নৌকার গতিবিধির খবর পাওয়া যায়নি এবং নতুন কোনো নৌকা তাড়ানোর ঘটনাও ঘটেনি।’
মালয়েশিয়া সংসদে জরুরি বিতর্ক : পেরলিসের জঙ্গলে সন্দেহভাজন রোহিঙ্গা মুসলিম ও বাংলাদেশীদের ১৩৯ গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর এ নিয়ে মালয়েশিয়ার সংসদে জরুরি বিতর্কের জন্য একটি প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। এ নিয়ে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে কিনা তা নিয়েই বিতর্ক হবে। বিতর্কের প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন গুই সিয়াও লিউং এমপি।
ডেপুটি স্পিকার দাতু ইসমাইল মোহাম্মদ বলেন, হাউজের তিনটি শর্তের সবগুলো পূরণ করায় প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকারের অজ্ঞাতে কিভাবে এ গণকবরের ঘটনা ঘটতে পারে? ১৩৯টি গণকবর ও ২৮টি বন্দিশিবিরের সন্ধান পাওয়ার ঘটনা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং এতে দেখা যাচ্ছে সরকার সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে এতে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে।’
সাগরে মার্কিন নজরদারি : অভিবাসী সম্মেলনে বিশ্ব সম্প্রদায়কে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অভিবাসী ইস্যুতে ২৯ মে থাইল্যান্ডে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এটাকে মানবিক সংকট উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ওই সম্মেলনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মঙ্গলবার ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে সমুদ্রে ভাসমান ৭,০০০ বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের প্রসঙ্গ উঠে আসে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি মুখপাত্র জেফ রাথকে বলেন, আন্দামান সমুদ্র ও বঙ্গোপসাগরের পরিস্থিতি আরও ভালোভাবে অনুধাবন করতে ও ভাসমান অভিবাসীদের শনাক্ত ও চিহ্নিত করতে মার্কিন নৌবাহিনীর নজরদারি বিমানগুলো সরকারগুলোকে সহযোগিতা করবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর একটি বিমান সমুদ্রে নজরদারি পরিচালনা শুরু করেছে। সরকারগুলো অভিবাসীদের আশ্রয় দিতে রাজি হওয়ায় ও মালয়েশিয়া সরকার অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সন্তুষ্ট বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গ্রামবাসীকে সহায়তার আহ্বান থাই পুলিশের : মানব পাচারকারীদের নিয়ে তথ্য দিতে জঙ্গলের পার্শ^বর্তী গ্রামবাসীদের কাছে সহায়তা চেয়েছে থাইল্যান্ড পুলিশ। দেশটির শৃংখলা প্রদেশের ওই জঙ্গলে ১ মে গণকবরের সন্ধান পায় পুলিশ। সেখান থেকে প্রায় ৩৫টি দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। বুধবার থাই পুলিশের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা এ আহ্বান জানান।

No comments

Powered by Blogger.