মানুষ, জঙ্গল ও বন্দিশিবির by সৈয়দ আবুল মকসুদ

উত্তর আচহের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বাংলাদেশ ও
মিয়ানমারের উদ্ধার হওয়া নারী ও শিশুরা
কত লাখ বছর আগে মানুষ বনজঙ্গলে বাস করত, সে সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা নেই। তবে কোনো একসময় জঙ্গলে বাস করতে মানুষ অভ্যস্ত ছিল। সেই জঙ্গলেই আদি প্রত্নপ্রস্তরযুগে মানুষ বাস করত যেখানকার আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত অনুকূল। শিকারযোগ্য জীবজন্তু অঢেল। মানুষ জীবনধারণের জন্য পশু শিকার করত। কোনো কোনো জঙ্গলে খাওয়ার উপযোগী ফলের গাছ, লতাপাতা ছিল প্রচুর।
এখন আর জঙ্গলে মানুষ থাকতে পারে না, কারণ জঙ্গলে মুদি দোকান নেই। চাল-ডাল-নুন প্রভৃতি পাওয়া যায় না। জঙ্গলে কাঁচাবাজার নেই। মাছ-তরিতরকারিও নেই। এমনকি দেশলাইটাও পাওয়া যায় না। ফলে আগুন জ্বালানোর উপায় নেই। সুতরাং রান্না বন্ধ। তাই একালে যারা জঙ্গলে থাকবে, তাদের অনাহারে মারা যাওয়াই নিয়তি, যদি বাঘ-ভালুক-অজগর মানুষকে গিলে না-ও খায়। অবশ্য বাঘ-ভালুক-অজগরের বিচার-বিবেচনা ও করুণা আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের চেয়ে বহু গুণ বেশি। বনের পশুও মানুষের চেয়ে কম নিষ্ঠুর।
কোরবানির হাটে ব্যাপারীরা গরু-খাসি নিয়ে আসে। দরদাম করে ক্রেতারা পশু কেনে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার গহন জঙ্গলে বহুদিন থেকে বসেছে মানুষের হাট। খুব তাড়াতাড়ি যে মানুষগুলো দাস হিসেবে বিক্রি হয়, তারা ভাগ্যবান। যাদের দাম ওঠে না, তারা হতভাগ্য। দানা-পানি না পাওয়ার ফলে মৃত্যু তাদের অনিবার্য।
দাসপ্রথা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার তা পুনঃপ্রচলন হচ্ছে। এবং দাস হিসেবে নাম লেখাচ্ছে সেই ভূখণ্ডের মানুষ, প্রায়-মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছে বলে উচ্ছ্বসিত যে দেশের নেতারা, অর্থনীতিবিদ, উপসম্পাদকীয় লেখক এবং ব্যবসায়ী নেতারা। প্রায়-মধ্যম আয়ের দেশ আমরা কাকে বলব? যেখানে তৃণমূল পর্যায়ের ক্যাডারদের আছে নতুন মোটরসাইকেল, ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতার আছে শেষ মডেলের জাপানি গাড়ি, উপজেলা পর্যায়ের নেতার মিৎসুবিশি পাজেরো। যে প্রায়-মধ্যম আয়ের দেশের ছাত্রনেতাদের আছে অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, আধুনিক বিপণিবিতানে দোকান এবং অমূল্য মোটরগাড়ি। যে দেশে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে এক হালি ইলিশের ক্রেতার অভাব নেই। যে দেশের অভিজাত এলাকার রেস্তোরাঁগুলোতে বাতি নেভে না রাত তিনটাতেও, বসার জায়গা না পেয়ে প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের অনেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন।
সেই প্রায়-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে কেন আর একশ্রেণির যুবক-যুবতী অজানার পথে যাত্রা শুরু করবে সত্যিকারের কোনো মধ্যম-আয়ের দেশে পাড়ি জমানোর আশা নিয়ে। বয়স হয়েছে কারও ১৭, কারও ১৯, কারও ২১, কারও বা ২৬। কাজকাম কিছু নেই। বাড়িতে দুবেলা ভাত জোটে না। বাপ-মায়ে রাগারাগি করে, ছোট বোনগুলো ঠিকমতো কথা বলে না। একদিন বাজারে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এক লোক কোত্থেকে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কি রে, বিদেশে যাবি?’
যুবক এই সুযোগ ছাড়তে নারাজ। বলে, ‘যামু।’
লোকটি বলে, ‘চল্, তাইলে তোরে আমার ওস্তাদের কাছে নিয়া যাই।’
ওস্তাদ খুব বেশি দূরে থাকেন না। তার সঙ্গে দেখা করতেই তিনি সব পথ বাতলে দেন। অমুক তারিখে রাত একটায় অমুক ঘাটে নাও থাকব। তুই খালি তাতে উইঠা বসবি গিয়া। তারপর সোজা মালয়েশিয়া। ওইখানে গিয়া দেখবি দুনিয়ার সবচাইয়া উঁচা দালান। উপরের তালায় চাইলে তোর মাথায় চক্কর দিব।
ছেলেটি ভেবে দ্যাখে, এ তো আল্লাহর খাস রহমত। এমন সুযোগ তো বাংলাদেশে আর কেউ তাকে দেবে না। সে কোনোরকমে কিছু হাতখরচ জোগাড় করে। এক ঘোর অমাবস্যার রাতে মা-বাপ-ভাইবোনদের কিছু না জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়। রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালে প্রতিবেশীর নেড়ি কুত্তাটা ঘেউ ঘেউ করে অনেকক্ষণ। সে দাঁড়ায়। পেছনে তাকিয়ে দেখে অন্ধকার ঘরে মা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে আর দাঁড়িয়ে না থেকে লম্বা পা চালায়। নৌকায় গিয়ে দেখে তার মতো আরও ৩৫ জন। ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছাড়ে। ফটফট আওয়াজ হয়। অজানার পথে শুরু হয় যাত্রা। সামনে তাকিয়ে দেখে কোথাও কোনো আলোর বিন্দু পর্যন্ত নেই। একদিন নৌকা গিয়ে এক ঘাটে থামে। তখনো মধ্যরাত। সেখান থেকে একজন তাদের নিয়ে যায় কোথায় তা তারা জানে না। যখন ভোর হয়, তখন দেখে কোথাও সেই মালয়েশিয়ার উঁচু দালান তো দূরের কথা, সেমিপাকা একতলা দালান বা টিনের ঘর পর্যন্ত নেই, চারদিকে নিস্তব্ধ জঙ্গল।
যুবকটি বাড়ি ছাড়ার পর দিন দশেক পার হয়। একদিন খেতে বসে ওর পিঠাপিঠি বোনটি মাকে বলে, মা, ভাই যে আসতেছে না? মা বলেন, আইব, বন্দরে গেছে। শয়তান ছ্যামরা একটা মোবাইল তো করব। ভাই আর আসে না। আর একদিন খেতে বসে জরিনার ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। গলায় ভাত আটকায়। জরিনার চোখ দিয়ে টপ করে দুফোঁটা পানি পড়ে ভাতের থালায়। মাকে কিছুই বলে না। মুরগিগুলোকে খাওয়াতে গিয়ে মা যে কতবার আঁচলে চোখ মুছেছে, সে কথাও জরিনা জানে না। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন একজন এসে জানায়, থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অনেকগুলো গণকবরের খোঁজ পেয়েছেন সাংবাদিকেরা।
মানব পাচার চিরকালই অনেক অঞ্চলে হয়। গরিব দেশ থেকে ভাগ্যান্বেষণে সমৃদ্ধ দেশে মানুষ যায় জীবিকার সন্ধানে। সমুদ্রপথে পাড়ি জমাতে গিয়ে কত মানুষ যে মারা গেছে, তার হিসাব জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরেও নেই। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় এবং সেখানে বন্দিশিবিরে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের উদ্ধার করার সংবাদ প্রচারমাধ্যমে আসায় বিষয়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টি পড়েছে। কয়েক দিন যাবৎ প্রতিদিনই বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে মানব পাচারের সংবাদ প্রচার করছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া। ১০ মে জাকার্তা থেকে সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, আগের দিনই দক্ষিণ-পশ্চিম ইন্দোনেশিয়ার উপকূল থেকে ৪৬৯ জন বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের হতভাগ্যকে নৌকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে ৮৩ যুবতী এবং ৪১ জন শিশু।
প্রচারমাধ্যমে গণকবর, জঙ্গলে বন্দিশিবির এবং মানব পাচারকারীদের বিচিত্র সংবাদ প্রকাশ পাওয়ার পর আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও কিঞ্চিৎ তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই মর্মান্তিক তথ্য যদি প্রচারিত না হতো, তা হলে কী হতো। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিরোধী দলের কর্মসূচি ঘোষণার পরদিনই ঘোষণা করে অমুক তারিখে অতটার সময় নাশকতা হবে। অপ্রধান দৈনিকের কোনো কোনোটিতে সে খবর খুব বড় করে প্রকাশিত হয়। আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলে দিতে পারেন ২০১৮-র ডিসেম্বরে অথবা ’১৯-এর জানুয়ারিতে যে নির্বাচন হবে, সেদিন তাতে কোন কোন কেন্দ্রে কারা বোমা মারবে, সে কথাও। কিন্তু এই যে হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ জীবিকার সন্ধানে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা অন্য কোথাও যাচ্ছে, সে সম্পর্কে গোয়েন্দাদের কিছুমাত্র ধারণা নেই। রোববার এক মানব পাচারকারীকে উখিয়ায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা করায় প্রশাসন জনগণকে জানিয়ে দিল, তারা মানব পাচারকারীদের শায়েস্তা করায় প্রচণ্ড আন্তরিক। তাদের তালিকা নাকি হালনাগাদ করা হচ্ছে।
রোগ আর উপসর্গ এক জিনিস নয়। গণকবর ও বন্দিশিবিরের সন্ধান পাওয়া, সেখানে বাংলাদেশিদের কয়েকজনকে উদ্ধার করা, তাদের দু-চারজনকে দেশে ফিরিয়ে আনা—এসব উপসর্গ, রোগ অন্য জিনিস। কেন এই মানুষগুলো নৌকায় উত্তাল সাগরে ভেসে অন্য দেশে যাচ্ছে, কেন তারা নৌকা থেকে সাঁতরে গিয়ে পাড়িতে উঠছে—সেসব বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা সরকার দেবে না। সরকার বহু উন্নয়নমূলক কাজে ব্যস্ত থাকায় এসব প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নয়। দোষ সরকারের নয়, রাষ্ট্রের।
থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বাঙালির গলিত লাশ উদ্ধার হওয়ার সংবাদ শুনে আমার একাত্তরের স্মৃতি মনে পড়ল। ষোলোই ডিসেম্বরের এক হপ্তা পরে ঢাকায় এসে আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম রায়েরবাজার। সেখানে ছিল গণকবর অথবা গলিত লাশ এবং শিয়াল-শকুনে খাওয়া মানুষের হাড়গোড়। একাত্তরে অগণিত বাঙালি গণকবরে গিয়ে শেষ আশ্রয় নিয়েছিল। চুয়াল্লিশ বছর পর বাঙালিকে আবার থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গিয়ে গণকবরে শেষ আশ্রয় নিতে হচ্ছে। সেদিন বাঙালি চেয়েছিল অর্থনৈতিক মুক্তি, আজও একটি বিরাট শ্রেণি অর্থনৈতিক মুক্তির আশায় সাগরে গিয়ে ঝাঁপ দিচ্ছে এবং অনেকে প্রিয়জনহীন পরবাসে মৃত্যুবরণ করছে। খবরে দেখলাম, বন্দিশিবিরগুলোতে নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন। নারী শিশু ও কিশোরীদের প্রলোভন দিয়ে নেওয়া হচ্ছে যৌনদাসী হিসেবে নিয়োগের জন্য। বন্দিদশা থেকে যাদের উদ্ধার করা হয়েছে, তারা জানিয়েছে, মুক্তিপণ আদায় করতে না পারায় অনেককে হত্যা করা হয়েছে। অনেকে অনাহারে ও রোগে মারা গেছে।
যেসব দালাল ফুসলিয়ে দরিদ্র মানুষদের পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়, তারা পায় রাষ্ট্রের মৌন অথচ পূর্ণ সহযোগিতা। পাঁচ বছর আগে যে পাচারকারীর বাড়িতে ছিল দোচালা টিনের ঘর, তাতে পাটখড়ির বেড়া, এখন সেখানে দোতলা দালান। আগে ছিল তার এক চিলতে জমি, এখন ক্রয়সূত্রে কয়েক একর এবং সরকারি খাসজমি দখল সাত একর। ব্যাংকে ঢের টাকা। আগামী কোনো নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থী হলে তার বিজয় ঠেকায় কে?
দেশ যে উন্নতির হিমালয় স্পর্শ করছে, তা প্রতিদিন মানুষ শুনছে। বিভিন্ন প্রজন্মের সন্তানেরা প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা দিয়ে হল ভাড়া করে গোলটেবিল করছেন। বইঠা সমর্থকগোষ্ঠীও গোলটেবিল ও মানববন্ধন করছেন। তাতে বড় নেতারা গিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। রাস্তার কোনো লোক তাদের কাছে গিয়ে জানতে সাহস পাচ্ছে না, হুজুর, বলেন, লাখ লাখ যুবক-যুবতী বিদেশে পাড়ি জমাতে যাচ্ছে কেন? মেধাবী শিক্ষিত বেকারদের চাকরি দিতে পারেন না, নিয়তির কারণে যারা শিক্ষাবঞ্চিত, প্রশিক্ষণের অভাবে যারা অদক্ষ, তাদেরও বাঁচার মতো জীবিকার ব্যবস্থাটা করে দিতে পারেন না। যে দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ পাচার হয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সে দেশের ভাবমূর্তি বলে কিছু থাকে না।
অব্যবস্থার সুবিধাভোগী একশ্রেণির মধ্যবিত্ত বিদ্বান যতই বগল বাজান, ষোলো কোটি সাধারণ মানুষের অবস্থা আজ থাই জঙ্গলে বন্দিশিবিরের মানুষগুলোর মতোই। এমন এক নৌকার তারা যাত্রী, যে নৌকা যাচ্ছে এক অজানা গন্তব্যের দিকে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.