নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো কার্যকর করার তাগিদ -প্রথম আলো–ইউনিসেফের গোলটেবিলে বিশেষজ্ঞরা

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল
‘পরিকল্পিত জন্ম ও নিরাপদ মাতৃত্ব’ প্রসঙ্গে আয়োজিত এক
গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা l ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো-ইউনিসেফ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মায়ের মৃত্যু রোধে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোকে পুরোপুরি কার্যকর করার তাগিদ দিয়েছেন।
নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস উপলক্ষে গতকাল বুধবার প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘পরিকল্পিত জন্ম ও নিরাপদ মাতৃত্ব’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সহযোগিতা করে কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি এবং ডিফাদডি কানাডা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বৈঠকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মা ও শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, মা ও শিশুমৃত্যু রোধে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে যেন একজন মা-ও আর মারা না যান, সে জন্য হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সন্তান প্রসবের হার বাড়াতে হবে। এর আগে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় গেলেই মায়েরা সেবা পাবেন—সে নিশ্চয়তা দিতে হবে।
বৈঠকে সামিয়া শারমিন নামের এক নারী বলেন, ছয় মাস আগে কোনো এক বৃহস্পতিবার রাতে তিনি প্রসববেদনা নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর খিঁচুনি শুরু হলে ওই হাসপাতালের একজন চিকিৎসক তাঁকে জানান, শুক্রবার চিকিৎসককে না-ও পাওয়া যেতে পারে। অস্ত্রোপচার শনিবারের আগে হবে না। পরে তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে চলে যেতে বাধ্য হন।
বৈঠকে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সরকারের সদিচ্ছা আছে। সীমিত সম্পদ নিয়েও সরকার চেষ্টা করছে। জরুরি প্রসূতিসেবার জন্য একই সঙ্গে শল্যচিকিৎসক ও অবেদনবিদ (অ্যানেসথেটিস্ট) প্রয়োজন। দেশজুড়ে অবেদনবিদের সংকট আছে। দরকার ১৫০০, পদ আছে ৫০০, তার মধ্যে ২৫০টি শূন্য। অবেদনবিদ, নার্স ও মিডওয়াইফের সংকট কাটানোর চেষ্টা চলছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মা ও শিশু বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ শরীফ বলেন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে চিকিৎসক-সংকট প্রকট। তবু মাঠপর্যায়ে তিন হাজারের ওপর কেন্দ্রে মায়েরা যেন স্বাভাবিক প্রসবসেবা পান, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রগুলো থেকে ভালো ফলও পাওয়া যাচ্ছে। সন্তান জন্মের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মায়েদের মৃত্যু হয়ে থাকে। এই মৃত্যু রোধে প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনা ও সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মায়ের মৃত্যু রোধে নজর দিতে হবে কিশোরী স্বাস্থ্যে: অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মায়ের মৃত্যু রোধ করতে হলে মেয়েরা যখন কৈশোরে পৌঁছাবে, তখন থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।
অবসট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি রওশন আরা বলেন, কিশোরীদের স্বাস্থ্য সমস্যার প্রতি নজর দিতে হবে আগে। কিশোরীরা তাদের প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করতে পারে না। প্রতিটি হাসপাতালে কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য আলাদা একটি কর্নার রাখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে। যাদের বিয়ে হয়ে গেছে, তারা যেন ২০ বছরের আগে গর্ভধারণ না করে, সে জন্য বয়সোপযোগী জন্মনিরোধক বড়ি থাকা দরকার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের প্রধান মো. সহিদুল্লা বলেন, বাংলাদেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী উপযুক্ত যৌন ও প্রজনন শিক্ষা কী হতে পারে, কোন সময় থেকে সেই শিক্ষা দিতে হবে, এসব নিয়ে আলোচনা দরকার।
প্রশ্ন যখন ব্যবস্থাপনার: ইউনিসেফের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রিয়াদ মাহমুদ আলোচ্যসূচি উপস্থাপনায় বলেন, বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার সব জেলায় সমানভাবে কমেনি। খুলনা থেকে সিলেটে মাতৃমৃত্যুর হার সাত গুণ পর্যন্ত বেশি। গড়ে প্রতিদিন দেশে ১৪ জন নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। প্রতিটি মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
রিয়াদ মাহমুদ আরও বলেন, সন্তানের জন্ম দিতে মায়েরা বেশি যাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার হার বাড়ানো দরকার। জরুরি প্রসূতিসেবা কেন্দ্রে (কমপ্রিহেনসিভ ইমার্জেন্সি অবসট্রেটিক কেয়ার) যেন ২৪ ঘণ্টা নারীরা সেবা পান, সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
ডিফাদডি কানাডার জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মোমেনা খাতুন বলেন, একটি জরুরি প্রসূতিসেবা কেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা সেবা দিতে কমপক্ষে তিন জোড়া শল্যচিকিৎসক ও অবেদনবিদ দরকার। সব কটি কেন্দ্রে এক জোড়া চিকিৎসকই দেওয়া যাচ্ছে না। কোনো কেন্দ্রে কাজ শুরুর আগে চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফ, ব্লাডব্যাংক, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ যা যা দরকার, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) পরিচালক শামস এল আরিফিনও বলেন, জরুরি প্রসূতিসেবা কেন্দ্রের সংখ্যা কত হবে, সে নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। গর্ভধারণের পর প্রতি ১০ জন নারীর নয়জন পরামর্শ নিতে চিকিৎসকের কাছে যান। কিন্তু চিকিৎসকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই।
ইউএসএআইডির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উম্মে সালমা জাহান মিনা বলেন, সম্প্রতি ইউএসএআইডির সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো সেবা দিতে কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা খুব একটা সুখকর নয়। কোথায় কী সমস্যা, তার প্রকৃত তথ্য হাতে নিয়ে কাজে নামতে হবে।
জাতিসংঘের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা কর্মসূচির মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ শামিনা শারমীন বলেন, গর্ভাবস্থায় দরিদ্র নারীদের মাত্র ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান, মাত্র ১৮ শতাংশ নারী দক্ষ ধাত্রীসেবা পান। দরিদ্র নারীদের মৃত্যুহারও বেশি। এদের কাছে সহজে সুলভে সেবা পৌঁছাতে হবে।
কোয়েকার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অ্যান ইউনিয়াং নার্সদের সংখ্যা ও দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।
নারীপক্ষের প্রকল্প ব্যবস্থাপক সামিয়া আফরিন বলেন, মাঠপর্যায়ে কেন্দ্রগুলো ঠিকমতো চলছে কি না, সেটি দেখার জন্য স্থানীয় সাংসদের নেতৃত্বে শক্তিশালী কমিটি আছে। কমিটিগুলো কাজ করে না, ফলে জবাবদিহিও নিশ্চিত হয় না।

No comments

Powered by Blogger.