ভর্তি বাণিজ্য বন্ধ করা কঠিন নয় by বেগম জাহান আরা

বেশ ক’বছর ধরে শিক্ষার মান উন্নত করার লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। পরিকল্পনায় শুধু নতুনত্ব নয়, প্রয়োগের চেষ্টাও প্রশংসনীয়। যেমন সৃজনমূলক শিক্ষা ও পরীক্ষা এবং প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষা। টেকস্ট বুক বোর্ডের বাংলা বইয়ে ‘শ্রেণি’ বানান লেখা হচ্ছে, যেটা প্রমিত বাংলা বানান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নতুন ও বৈপ্লবিক বলে মনে করা হয়। লাখ লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে দেশকে। বছরের প্রথমেই কোটি কোটি বই পৌঁছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে, এটাও ইতিবাচক ঘটনা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং খোদ শিক্ষামন্ত্রী দিলখুশ আছেন।
খ্রিস্টীয় বছরটা যাই যাই করছে। শিক্ষাঙ্গনে নতুন ভর্তির দামামা বাজছে। লাখ লাখ শিশু প্রস্তুত হচ্ছে ঘরে ঘরে। অবশ্য ফরম বাণিজ্য শুরু হয়ে গেছে আগেই। প্রতিবছরই ভর্তি ফি নির্ধারণ নিয়ে নতুন অংক শুরু হয়। এবারও হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেই ঘোষণা এসেছে, ‘সরকারি-বেসরকারি স্কুলে এবার ভর্তি ফি বাড়ছে’। একটা তালিকাও দেয়া হয়েছে, কোন স্কুলে কেমন ফি নেয়া যাবে। দেশে তো স্কুলেরও শ্রেণী আছে। যেমন- সম্পূর্ণ এমপিওভুক্ত, আংশিক এমপিওভুক্ত এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। আছে ক, খ, গ, মানের স্কুলও।
ভর্তির ভিড়টা হয় মূলত প্রথম শ্রেণীর পথে। কচি কচি শিশুদের যে জ্যাম দেখা যায় ভর্তি পরীক্ষার দিনে, তাতে মায়া লাগে বেচারাদের জন্য। মা-বাবা, শিশু, গাড়ি, রিকশা- সব মিলে যেন অস্ত্রহীন যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হয়। সেটার না হয় যুক্তি আছে। স্কুলে আসনের চেয়ে শিক্ষা নেয়ার উপযোগী শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি। আর ভালো একটা স্কুলে (ব্র্যান্ডেড জিনিসের মতো) ভর্তির জন্য অভিভাবকরা উদগ্রীব-উদ্বিগ্ন এবং আশা নিয়ে অপেক্ষা করেন সারা বছর। ছোট্ট পুতুলের মতো বাচ্চাগুলোকে টেনেহিঁচড়ে কোচিং করাতে করাতে প্রাণান্ত করেন। তারপর না ভর্তিযুদ্ধের ময়দান? সেও কী, একটা স্কুলেই তো ভর্তি পরীক্ষা দেয় না শিশুরা। একাধিক স্কুলে দৌড়াতে হয় মা-বাবার সঙ্গে। প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মতোই প্রক্রিয়াটা। শিশুরা কিন্তু বুঝতেই পারেন না কেন এ দৌড়াদৌড়ি? আলাভোলা মুখে নির্বিকার অসহায় ভাব। উৎকণ্ঠায় কাতর মা-বাবারা। বাচ্চারা বারবার মা-বাবার দিকে চায়। তাদের কষ্ট শেয়ার করাও বোঝে না। সে বয়সও নয় তাদের। তবু ভর্তিযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে ময়দানে এসে দাঁড়াতে হয়। কিন্ডারগার্টেনগুলোর চিত্র আরও ভয়ানক। ওরা তো না পারে ভালো করে হাঁটতে, না পারে ভালো করে কথা বলতে। মায়েরাই মূলত টেনেটুনে নিয়ে যান। সময়টা শীতকাল। পর্যাপ্ত কাপড়-চোপড় থাকে গায়ে। মনে হয় বাচ্চাগুলো পুতুল-পোঁটলা। ভর্তিযুদ্ধের ঠেলাঠেলি হইচই দেখে প্রচুর কান্নাকাটিও করে শিশুরা। কিন্তু রেহাই নেই কেঁদে। ভর্তি হতে হবে। একটা না একটা শিক্ষাখানায় জায়গা পেতেই হবে। তা সে মেধায় হোক বা টাকার বিনিময়ে হোক।
এমন ভয়াবহ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আমাদের শিশুদের শিক্ষাজীবন। শিক্ষার প্রতি আকর্ষণের চেয়ে বিকর্ষণই হয়তো দানা বাঁধে তাদের মনে। এসব সমস্যার তো সমাধানই করা যাচ্ছে না। তার ওপর বছর বছর ভর্তি ফি বাড়ে। ভর্তির ফরমের দাম বাড়ে। স্কুলের মাসিক বেতনের অংক বাড়ে। কোচিংয়ের খরচ বাড়ে। কপাল ভালো যে, নাগরিক জীবনে পরিবার পরিকল্পনা কিছুটা আছে। শিক্ষার্থী শিশুর সংখ্যার তুলনায় স্কুলের সংখ্যার অনুপাতে কুলিয়ে যাচ্ছে কোনোরকমে।
স্কুল যারা পরিচালনা করেন, তারা তো বাণিজ্যের দিকটা দেখবেনই। এতকাল সেটাকে দমিয়ে রাখার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা শাসন-বারণ ছিল। কিন্তু এবার সরকারি সিদ্ধান্তে ভর্তি ফরমের দাম এবং ভর্তি ফি’র অংক বাড়ানোর ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। এটারই অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। এটা তো বেহুলার বাসর ঘরে সুচের ছিদ্র হয়ে যাবে! এ ছাড়পত্রের সাহসে বিদ্যাবাণিজ্যের দরজা খোল্লাম খুল্লা হয়ে যাবে কোথাও কোথাও। এমন প্রবণতা বরাবরই ছিল। যে যেভাবে পারে গলাকাটা টাকা আদায় করে নেয় ভর্তির মৌসুমে। কারও বলা কওয়া, ঘোষণা, ছাড়পত্রের ধার ধারে না তারা। ওরা ভিন্নপথের সাহসী পথিক।
একটু হিসাব করাই যাক। ভর্তির ফরম তো সেই একখানা কাগজই। তার দাম বাড়ানোর যুক্তিটা কী? এক লাফে ৫০ টাকা কেন? ১০ টাকা বাড়ানো যেতে পারত। এ কাগজটার মারেফাত কী? কোথাকার তৈরি? ডিজিটালি মেড? অনলাইনে ভর্তি ফরম পূরণের মূল্য তো কমার কথা? অন্যদিকে ভর্তির ফি কেন বাড়বে? কী এমন সেবা দেয়া হবে যে, সম্পূর্ণ এমপিওভুক্ত স্কুলের ভর্তি ফি ৫ হাজার টাকায় কুলোবে না? আংশিক এমপিওভুক্ত বাংলা মাধ্যম স্কুলে ৮ হাজার টাকা ভর্তি ফিও তো অনেক। আর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ১০ হাজার টাকা ভর্তি ফি শোনা গেলেও বাস্তবচিত্র অন্যরকম। অভিভাবকরা তা-ই বলেন। ভর্তি ফি’র সঙ্গে আরও কত রকম উন্নয়ন খাত যে থাকে, তা শুনেও মনে রাখতে পারি না। সব খাতেই টাকা দিতে হয়। তখন ভর্তি ফি’র অংকটা হয় বেশ ভারিই। এসব নিয়ে অভিভাবক মহলে সমালোচনা-অসন্তোষ চলে সারা বছর। আবারও প্রশ্ন, কী এমন ঘটবে আগামী বছর যে, ভর্তি বাণিজ্য বাড়াতে হবে? চাল ডাল ভোজ্য বস্তুর মতো?
ভর্তি ফরম এবং ভর্তি ফি বাড়ানোর সরকারি ঘোষণার তিন-চার দিন পর আর এক সিদ্ধান্ত জারি করা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে- বেসরকারি স্কুলে এবার ভর্তি ফি বাড়ানো যাবে না। তিন দিন আগের সিদ্ধান্তে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি ফি বাড়ছে জানার পর বেসরকারি স্কুলগুলোও তৈরি হয়ে গেছে প্রক্রিয়া চালু করার জন্য। পরের ঘোষণায় বেসরকারি স্কুলগুলো নাখোশ। আগামী শিক্ষাবর্ষে তারাও ফরমের দাম, ভর্তি ফি এবং মাসিক বেতন বাড়ানোর দাবি তুলেছে। এটাই স্বাভাবিক। সরকারি-বেসরকারি সব স্কুলের পাঠ্যবই তো একই। শিক্ষকদের বিদ্যাগত যোগ্যতাও প্রায় এক। কর্মঘণ্টাও অভিন্ন। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয় অভিন্ন প্রশ্নে। তাহলে বেসরকারি স্কুলগুলোর কমতি কোথায়? হয়তো দালানকোঠায় কিছু কম থাকতে পারে। তাই বেসরকারি স্কুল পক্ষকে এখন সমঝানোর পালা। সত্যি কথা হল, শিক্ষকরা সবাই চাকরি করেন। অবসরে কোচিং করেন। শিক্ষা সেবা কেউ দেন না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
এক দাড়িপাল্লার জন্য দু’রকম বাটখারার ব্যবহার নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করার প্রয়োজন কী ছিল তা আমরা বুঝিনি। তবে শিক্ষা নামক মিছরির ছুরিতে এধার-ওধার দু’ধারেই গা কাটবে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর। অর্থনৈতিক চাপে যারা ক্লিষ্ট-পিষ্ট হয়েই বেঁচে থাকেন। আমি যতটা জানি, চাকরিজীবীদের বার্ষিক একটা ইনক্রিমেন্ট থাকলেও ধাবমান বাড়তি খরচের সঙ্গে তা দিয়ে পেরে ওঠা যায় না। একজন শিক্ষকই বা বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট কত পান? আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য না থাকলে কেউই মাথা ঠাণ্ডা রেখে চাকরি করতে পারে না। চাকরি সেবা তো দূরের কথা। তাই স্কুলে ভর্তি ফরম, ভর্তি এবং মাসিক বেতন বাড়ানোর বিষয়টাকে সাধারণ একটা সিদ্ধান্ত বা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে চালু করা যাবে ভাবলে ভুলই হবে। আমি তো এ মুহূর্তে কোনো রকম স্কুলেই ব্যয় বৃদ্ধির কারণ দেখি না। তবে আমাদের কথার দাম কী?
শোনা যায়, দেখাও যায়, স্কুলের ভেতরেও কিছু বাণিজ্য আছে। তার মধ্যে এক নম্বর- স্কুল ইউনিফর্ম বাণিজ্য। আসলে আমরা, ব্যতিক্রম ছাড়া, সবাই এমন বাণিজ্যপ্রবণ হয়েছি যে সেবা শব্দটাই ভুলে গেছি। স্কুল শিক্ষা পর্বে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেবা। এ দেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা সেবা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। অর্ধেক জনসংখ্যা এখনও শিক্ষাবঞ্চিত। কোটি কোটি শিশু স্কুলে পড়ার সুযোগই পায় না। যদিও বা চেষ্টা করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের স্কুলে আনা হয়, তারা অনেকেই ঝরে পড়ে। কেন পড়ে, তাও ঠিক বোঝা যায় না। আর রাজধানীর স্কুলে চলে প্রতিযোগিতার বিদ্যাবাণিজ্য। জিপিএ-৫ পেয়েও তাদের অধিকাংশেরই মেধার বিকাশ ঘটে না। কেন এমন হয়, তা নিয়েও নেই কোনো গবেষণা।
কথায় কথায় উন্নত বিশ্বের প্রসঙ্গ তুলি আমরা। বলি বিশ্বমানের শিক্ষাদানের কথা। বলি ইংরেজি ও অংকের ওপর জোর দিতে হবে। মরেছি তো এখানেই। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। অস্তিত্বের ভাষা। বুদ্ধিবৃত্তি বিকশিত হওয়ার ভাষা। মনের দশদিগন্ত খুলে দখিনা বাতাস উপভোগের ভাষা। বুদ্ধিবৃত্তি কর্ষণের ভাষা। সুকুমারবৃত্তি বিকশিত করার ভাষা। বাংলা ভালো করে না জানলে, না শিখলে বুদ্ধির জড়ত্ব যে কিছুতেই ঘুচতে চায় না, এ কথাটা বিশ্বাস করতেই হবে। আমরা তো সাদা চোখেই দেখি, বিএ, এমএ পাস করেও ছেলেমেয়েরা সুন্দর করে গুছিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। লিখতেও পারে না। হাতের লেখার কথা বাদই দিলাম। প্রাথমিক পর্বে তাই শিশুদের বাংলা শেখাতে হবে যত্ন দিয়ে। সেবা দিয়ে। প্রয়োজনে টাকা দিয়েও। প্রথমে পাকা করতে হবে জীবনের অস্তিত্বের ভিত। বাংলাভাষী হওয়ার পর ১০টা ভাষা শিখুক না। তখন কাজটা সহজ হবে।
ড. বেগম জাহান আরা : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.