ক্ষোভে ফুঁসছে সারা দেশ

টিআর কাবিখার টাকায় সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস স্থাপনের খবর শুনে দেশজুড়ে সচেতন মহলসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ-অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, দিনমজুর, শ্রমিক ও হতদরিদ্র লোকজন এক রকম ফুঁসে উঠছেন। কেননা, বছরের এই সময়টাতে টিআর কাবিখার বরাদ্দে গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট সংস্কারসহ ছোটখাটো অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে এক ধরনের কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এক অর্থে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মুখের গ্রাস এভাবে সোলার প্যানেল স্থাপনের নামে কেড়ে নেয়ায় তারা সরকারের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। কেউ কেউ বলছেন, এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে দুর্নীতি ও লুটপাট করার টিকিট দিয়ে দেয়া হল। এতে করে টিআর কাবিখার দেড় হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ ভয়াবহ এক দুর্নীতির ফাঁদে আটকা পড়বে। রোববার যুগান্তরের বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধির পাঠানো তথ্যে এমন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে এখনও সময় আছে, সরকারের সুমতি হওয়া উচিত। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা না হলে সরকারকে আগামী নির্বাচনে চরম খেসারত দিতে হবে। কেননা দলীয় কর্মী-সমর্থকের বাইরে রয়েছে সাধারণ ভোটারের এক বিরাট অংশ। অনেকে জানিয়েছেন, টিআর ও কাবিখার বরাদ্দ থেকে সোলার প্যানেলের দুর্নীতির ভাগবাটোয়ারা না সরালে তারা ভোটের সময় ব্যালটের মাধ্যমে এর জবাব দেবেন।
জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে এ রকম জনঅসন্তোষ দেখা দিলেও নিশ্চুপ রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এখনও এ মন্ত্রণালয়ের টনক নড়েনি। রোববার পর্যন্ত এ সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি । একটি সুত্র যুগান্তরকে জানায়, রোববার এ বিষয়ে যুগান্তরে প্রধান শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সকালেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করেন। তবে এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধনে এখনও তার কাছে কোনো নির্দেশনা আসেনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সোলার প্যানেল স্থাপনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, ‘আগে তো টিআর কাবিখার টাকায় রাস্তাঘাট না করে সবাই কমিশন ভাগ করে নিতেন। এবার অন্তত গরিব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস পৌঁছবে।’
ফুঁসে উঠেছে সারা দেশের জনপ্রতিনিধিরা : কাবিখা ও টিআর কর্মসূচির অর্থে সোলার প্যানেল ও ব্যায়োগ্যাস স্থাপনের সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে সারা দেশ। এ সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে জনপ্রতিনিধিরা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কুমিল্লা ব্যুরো থেকে নজরুল ইসলাম দুলাল জানিয়েছেন, কুমিল্লায় টিআর ও কাবিখায় বরাদ্দকৃত অর্ধেক অর্থ সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস স্থাপনের কাজে বাধ্যতামূলক ব্যয় করা হলে অনিয়ম ও দুর্নীতি আরও বাড়বে। পাশাপাশি গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। এ বিষয়ে জেলার বরুড়া উপজেলার ৯নং দক্ষিণ শীলমুড়ি ইউপি চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন মজুমদার বলেন, এটা সরকারের ভালো কোনো সিদ্ধান্ত নয়। গালিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল হোসেন জানান, এ সিদ্ধান্তে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়নে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হবে। জেলার বুড়িচং উপজেলার সদর ইউপি সদস্য আবদুল কাদের জানান, এতে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বুড়িচং উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এ প্রকল্প একটি দৃশ্যমান প্রকল্প। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানে সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস স্থাপন করা হবে সেসব প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প কমিটি সৎ না হলে সরকারের উদ্যোগ ভেস্তে যাবে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ইউপি সদস্য জানান, সরকারের এ সিদ্ধান্তে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে প্রাপ্ত বরাদ্দ উভয় কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে ভাগবাটোয়ারা আরও বেশি হবে এবং এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকমাত্রায় অবহেলিত ও বঞ্চিত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
বগুড়া ব্যুরো থেকে মো. নাজমুল হুদা নাসিম জানিয়েছেন, কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও টেস্ট রিলিফ (টিআর) বরাদ্দের অর্ধেক অর্থ দিয়ে সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস স্থাপন বাধ্যতামূলক করায় দুস্থরা ক্ষতিগ্রস্ত এবং এলাকার উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এতে তৃণমূল জনপ্রতিনিধিদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সংসদ সদস্যরা সন্তুষ্ট হলেও উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা নাখোশ হয়েছেন। রোববার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মাসিক কর্ণধার সভায় উপজেলা চেয়ারম্যান আপত্তি জানিয়েছেন। তারা এ ব্যাপারে সরকারকে আলাদা বরাদ্দ দিতে বলেছেন।
বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ফোরাম বগুড়া শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক সদরের শাখারিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ান শফিক জানান, সরকারের এ সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। এ নির্দেশ মানলে এলাকার উন্নয়ন কাজ অর্ধেকে নেমে আসবে। এছাড়া গ্রামের দুস্থ মানুষরা বঞ্চিত হবে। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি চেয়ারম্যান শফিক আরও জানান, বগুড়ায় বিদ্যুৎ সংকট নেই। তাই এখানে সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস প্লান্টের প্রয়োজন নেই। তার ধারণা, এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
কাহালুর নারহট্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন তালুকদার বেলাল, শেরপুরের সুঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মামুন জিহাদ বলেছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তে এলাকার উন্নয়ন কাজ চরমভাবে ব্যাহত হবে। সোনাতলা উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম আহসানুল তৈয়ব জাকির জানান, সরকারের এ সিদ্ধান্ত মোটেও ভালো নয়। এমনিতে টিআর ও কাবিখা বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তারপরও অর্ধেক হয়ে গেলে কোনো উন্নয়ন কাজই হবে না।
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি মতিউর রহমান জানিয়েছেন, যেসব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রকল্প দেয়া হয়েছে তাদের বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্যের যে মূল্য তা না দিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের একজন ঘনিষ্ঠ আÍীয় ওই সব প্রকল্পের সোলার প্যানেল কিনে দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করার পর থেকে ডিওহোল্ডাররা ডিও নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। সোলার প্যানেলের নামে ইতিমধ্যে বাণিজ্য শুরু হয়েছে।
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি রেফাজুর রহমান জানিয়েছেন, টিআর কাবিখা বন্ধের সিদ্বান্তে ফুঁসে উঠছে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি ও সর্বস্তরের মানুষ। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে জনপ্রতিনিধিরা অবদান রাখতে পারত। কিন্তু এই প্রকল্প বন্ধ হলে গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। সোলার ক্রয়ের মাধ্যমে আরেক দফা দুর্নীতির সুযোগ দেয়া হচ্ছে বলে সুধীসমাজ অভিমত ব্যক্ত করেন।
দেলদুয়ার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম ফেরদৌস আহমেদ বলেন, সরকার টিআর কাবিখা বন্ধের সিদ্বান্ত অবিলম্বে বাতিল করা উচিত। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ উপকারভোগী হতো। কিন্তু সোলার ক্রয় প্রকল্পে জনগণ সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে। একই উপজেলার সদর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বলেন টিআর কাবিখার মাধ্যমে আমরা জনগণের উন্নয়ন করতে পারতাম। কিন্তু সোলার দিয়ে জনগণের সন্তুষ্ট করা যাবে না। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
পিরোজপুর প্রতিনিধি এসএম পারভেজ জানান, পিরোজপুরের বিভিন্ন ইউপি চেয়ারম্যান ও সচেতন মানুষ যুগান্তরে রোববার প্রকাশিত ‘লুটপাটের নতুন আয়োজন’ প্রতিবেদনটি পড়ে হতবাক হয়েছেন। ভাণ্ডারিয়া উপজেলার নদমূলা শিয়ালকাঠি ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল কবির তালুকদার বলেন, নদী ভাঙনকবলিত এলাকা আমার, নেই রাস্তাঘাট। এসব এলাকার দুস্থ মানুষজন কাজ করে পেটে দু’মুঠো অন্ন চায়। সেখানে সোলার প্যানেল বা বায়োগ্যাস করে তাদের মুখে হাসি ফোটানো যাবে না। কাউখালী উপজেলার বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি আঃ লতিফ খসরু বলেন, গ্রামীণ অবহেলিত দুস্থ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা বিবেচনা করে টিআর কাবিখা প্রকল্প বন্ধ না করে চালু রাখা উচিত। সদর উপজেলার কলাখালী ইউপি চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সে প্রকল্প চলে যাবে ব্যক্তিস্বার্থে, সাধারণ দুস্থ মানুষের উপকারে আসবে না। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাবে।
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি স্বপন চৌধুরী জানিয়েছেন, কাবিখা ও টিআর প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে অর্ধেক ব্যয়ে সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস প্ন্যান্ট স্থাপন বাধ্যতামূলক করার সংবাদে জেলার তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। জেলার একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, কাবিখা ও টিআর খাতের বরাদ্দ করা খাদ্যশস্য দিয়ে এতদিন গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার কাজ করা হতো। কিন্তু বরাদ্দের অর্ধেক অংশ নতুন নিয়ম অনুসারে ব্যয় করা হলে দুস্থবান্ধব এ কর্মসূচি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একাধিক জনপ্রতিনিধি জানান, সরকারি নির্দেশনা মানতে তারা বাধ্য। কিন্তু এতে গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নের ধারায় একটি সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, টিআর কাবিখার বরাদ্দকৃত অর্থ সোলার প্যানেল ও ব্যায়োগ্যাস স্থাপনের কাজে ব্যয়ের নির্দেশনায় হবিগঞ্জে ইউপি চেয়ারম্যানদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। তবে কেন দরিদ্র মানুষগুলোর এ অর্থ কেটে নেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। রোববার যুগান্তরের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বানিয়াচংয়ের ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী মমিন জানান, টিআর কাবিখার দায়িত্বও এমপিদের হাতে রয়েছে। তাদের হাত থেকে কিছু ছিটেফোঁটা পায় চেয়ারম্যান মেম্বাররা। তা দিয়েই যা সম্ভব কিছু কাজ হয়। এটি বন্ধ হয়ে গেলে তো তাও হবে না। এছাড়া এমনিতেই তো শুধু লুটপাট আর লুটপাট। এটি লুটপাটের আরও একটি নতুন রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.