পরীক্ষা ছাড়াই ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ দিয়েছিলেন চিকিৎসক

পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই প্রথমবার ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত সেই নারীর। ওই ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়ারও ২৪ ঘণ্টা পর মারা যান তিনি। নিয়মনীতি অনুসরণ ও পর্যাপ্ত পরীক্ষা না করেই জীবিত ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করায় ফুটে উঠেছে কর্তব্যরতদের চরম অবহেলার চিত্র। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্যান্য রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, কর্তব্যরতরা তাদের রোগীদেরই ঠিকমতো দেখেন না, সেখানে একজন অজ্ঞাত রোগীর ক্ষেত্রে অবহেলা করবেন এটাই স্বাভাবিক। এ ঘটনায় সেবাপ্রার্থী রোগী ও তাদের স্বজনদের ভেতরে যেমন  উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে তেমনি দেশের বৃহৎ ও পুরাতন এ হাসপাতালের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটিও বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের উপ-পরিচালক অধ্যাপক ডা. মুশফিকুর রহমান। তিনি জানান, তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কথা। যাকে এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে তিনি একজন সিনিয়র চিকিৎসক। ভালভাবে তদন্ত করেই তিনি এ ব্যাপারে প্রতিবেদন দেবেন। আজ সোমবার এ প্রতিবেদন দাখিল করার কথা রয়েছে। ডা. মুশফিকুর রহমান আরও বলেন, কমিটি যদি মনে করে আরও সময় প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে তারা দু’একদিন সময় নেবেন। তবে তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. এনামুল করীম বিষয়টি তদন্তাধীন থাকায় এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে চাননি। এদিকে রোগীকে মৃত ঘোষণার আগে চিকিৎসকের যেসব নিয়ম মানার কথা, তা ঠিকঠাক মানা হচ্ছে কিনা, অথবা সেই নিয়মে  কোন পরিবর্তন আনা প্রয়োজন কিনা, সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। মারা যাওয়ার একদিন আগে ওই নারীকে মৃত ঘোষণা করার ব্যাপারে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলেন ডেথ সার্টিফিকেট  দেয়ার আগে সেদিন দায়িত্বে থাকা সেই নারী চিকিৎসক ডা. নিলুফার নিলু রোগীকে পরীক্ষাই করেননি। এদিকে নজিরবিহীন এ ঘটনায় ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসকরা যেমন সমালোচনার মুখে পড়েছেন, তেমনি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে স্বাস্থ্য সেবার মান। এ ব্যাপারে একজন সিনিয়র চিকিৎসক বলেন, ওই চিকিৎসক ব্যক্তিগতভাবে চূড়ান্ত দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। সেই নারী চিকিৎসক যিনি রোগীর ডেথ সার্টিফিকেটে সই করেন তিনি হাসপাতালের একজন অনারারি মেডিকেল অফিসার (এইচএমও)। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষে প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বিনা বেতনে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। এই অনারারি মেডিকেল অফিসাররাই হাসপাতালের চিকিৎসা সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সরকারি এই হাসপাতালটিতে সব সময়ই শয্যার চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ রোগী সামলাতে হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে কাজে আসার পরপরই ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডের অজ্ঞাত সেই নারীকে ওই চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। হাসাপাতালে ভর্তির প্রথম থেকেই রোগীটি সংজ্ঞাহীন ছিলেন। দায়িত্বরত আগের চিকিৎসক পালা বদলের সময় মৌখিকভাবে জানিয়ে যান যে ওয়ার্ডের মেঝেতে চিকিৎসাধীন ওই রোগীর অবস্থা সঙ্কটজনক। কিন্তু না বুঝে তার অর্থ করা হয়, রোগীটি মারা গেছেন। ওই ওয়ার্ডের এক সহকারী, যিনি ডেথ সার্টিফিকেট তৈরির কাজে চিকিৎসককে সহযোগিতা দিয়ে থাকেন, তিনি দায়িত্বে আসা নতুন এইচএমওকে ডেথ সার্টিফিকেট দিতে বলেন। এরপর চিকিৎসক রোগীকে পরীক্ষা না করেই সার্টিফিকেটে সই করে দেন। মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক টিটু মিয়া জানান, নাড়ির গতি (পালস), রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস ও মস্তিষ্ক পুরোপুরি অচল কিনা তা দেখে তবেই একজন রোগীকে মৃত ঘোষণা করার নিয়ম। তিনি বলেন, যখন আমরা নিশ্চিত হই যে, রোগীর এ সবের কোনটাই কাজ করছে না তখনই কেবল আমরা তাকে মৃত ঘোষণা করতে পারি। তবে অনেক সময় ইসিজি করারও পরামর্শ দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, চোখের মণিতে আলো ফেলে দেখা হয়, শরীরের রিফ্লেক্সও আমরা পরীক্ষা করি। এতে বোঝা যায়  রোগীর মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ড সচল কিনা। তবে কখনও এমন হতে পারে যে, রোগীর হৃৎস্পন্দন, নাড়ির গতি, শ্বাস-প্রশ্বাস কিছুক্ষণ থমকে থেকে আবার ফিরে এসেছে। আর সে কারণেই নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইসিজি করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা তাদের জন্য একেবারেই নতুন উল্লেখ করে তিনি বলেন এ থেকে আমাদের শেখার আছে। এখন আমরা একটি চেক লিস্ট তৈরি করতে পারি, যার সবগুলোর  উত্তর পেলেই হাসপাতালের একজন রোগীকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করতে পারবে। টিটু মিয়া জানান, তারা সবসময়ই কাউকে মৃত ঘোষণা করার আগে চিকিৎসকদের অন্তত ৩০ মিনিট সময় নিতে বলেন। কনিষ্ঠ চিকিৎসকরা নিশ্চিত হতে না পারলে তাদের সিনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বলা হয়। তবে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ রোগীকে মৃত ঘোষণার ক্ষেত্রে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েকটি বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত চিকিৎসকদের একটি বোর্ড চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। গত ২রা ডিসেম্বর হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সময় অজ্ঞাতপরিচয় ওই নারীকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চিকিৎসার জন্য ভর্তির ব্যবস্থা করেন হাসপাতালের পরিচালক। তাকে দুর্বলতা, পুষ্টিহীনতার চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার দুপুরে ওয়ার্ডে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. নিলুফার নিলু তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এর ৩ ঘণ্টা পর সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ময়নাতদন্তের জন্য এক ডোম লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য এলে দেখেন তিনি নড়ে উঠছেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায় তিনি জীবিত। কিন্তু শুক্রবার বিকালে তিনি সত্যিই মারা যান।

No comments

Powered by Blogger.